ভ্যাকসিন: বিভ্রম আর দুর্ভাবনা

কৌস্তুভ পান্ডা

সমগ্র মনুষ্যজাতিকে যতরকম সাধারণ শত্রুর সঙ্গে লড়তে হয়েছে, তার কোনওটাই কোভিড-১৯-এর সঙ্গে লড়াইয়ের মতো নয়। সেসব লড়াইতে এমন অপ্রত্যাশিত মোচড় ছিল না, সে সব লড়াই কখনও এমন ধাঁধা লাগায়নি, সে সব লড়াই আমাদের ক্রমশ এমন হতাশ করে তোলেনি। সে কারণেই, এই ভাইরাসটার বিরুদ্ধে আমরা কোন অস্ত্র ব্যবহার করব তার থেকেও বড় কথা হল আমাদের রণকৌশলটা কী হবে।

আজ অবধি আমরা এমন কোনও একক ওষুধ খুঁজে পাইনি, বা একক কোনো চিকিৎসা পদ্ধতিও বের করতে পারিনি যাতে ভাইরাসটাকে আমাদের শরীরের ভেতর মেরে ফেলা যায়। নিরাময়ের জন্য যতরকম হাতিয়ার ব্যবহার করা হচ্ছে তার সমস্তই আদতে অন্য কোনও রোগের ওষুধ, সেগুলোই ঘুরিয়ে কাজে লাগানো হচ্ছে মাত্র। এর অর্থ হল, সেগুলো ইতিমধ্যেই অন্য কোনও না কোনও রোগের চিকিৎসায় বা ভাইরাস দমনে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু এই বিশেষ ভাইরাসটির বিরুদ্ধে তার কোনওটারই কার্যকারিতা আগে পরীক্ষা করে দেখা হয়নি, বা তার সাফল্য অবিসংবাদিত ভাবে প্রমাণ করা হয়নি। এ কথাটা আজ ক্রমশ বিবর্তিত নানা ভ্যারিয়েন্টগুলোর দিকে তাকিয়ে আরও বেশি করে সত্য বলে মনে হচ্ছে।

এই ভাইরাসের মোকাবিলার জন্য এরপর আর যে সম্ভাব্য পথটা পড়ে থাকে তা হল ভ্যাকসিন। ভ্যাকসিন ব্যবহারের মূল উদ্দেশ্য হল ভাইরাসের বিরুদ্ধে আমাদের শরীরে একটা দুর্গ গড়ে তোলা অর্থাৎ একটা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। কিন্তু এগুলো রোগ যখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তখন কাজে লাগার মতো কোনও ওষুধ নয়, তাই ভাইরাস আক্রমণ করতে পারে এমন ভাবনা উদয় হওয়ার সময়েই সেটা  প্রয়োগ করা দরকার।

ফলে, অতিমারী যখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তখন জোরদার ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরু করা হল শত্রু এসে পড়ার পর দুর্গ গড়তে বসার সমান। এতে পরাজয় ঘটারই সমূহ সম্ভাবনা। কারণ ভাইরাসটা যখন সত্যি সত্যি আমাদের আক্রমণ করবে তখন আমাদের প্রতিরোধ হয়তো আধাখ্যাঁচড়া রকমে তৈরি হয়েছে বা একেবারেই হয়নি।  এই বিপদটা বিশেষ করে খুবই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে যখন দ্রুত মিউটেশনের মধ্য দিয়ে ভাইরাসটা তার চেহারা আর রোগলক্ষণের তীব্রতার মাত্রা  অবিরত বদলে বদলে ফেলে। আমাদের শরীরের অনাক্রম্যতা শক্তিকে বা ইমিউনোলজিক্যাল ডিফেন্সকে তা বিভ্রান্ত করে দেয় এবং তাকে এড়িয়ে যায়। কাজেই ভ্যাকসিন নেওয়া মানেই যে তা আমাদের শরীরে ইমিউনিটির অভ্রান্ত আশ্বাস, এ কথাটাকে নির্বিচারে গ্রহণ করা যাবে  না।

দেখেশুনে মনে হচ্ছে বহু মানুষই প্রথম এক ডোজ ভ্যাকসিন নিতেই  এমন একটা ভ্রান্ত মোহে ভুগছেন যেন অনাক্রম্যতার দাক্ষিণ্য পেয়ে গেছেন। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা বা মুখোশ পরা, এর কোনোটাই তাঁদের কাছে আর জরুরি বলে ঠেকছে না। এতে আরও বেশি করে সংক্রমণ ছড়াবে এবং জনসমাজকে তা আরও বিপদে ফেলবে।

অনেকে বলছেন, কেবল মাত্র ভ্যাকসিন দেওয়ার মধ্য দিয়েই আমরা হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে পারব। এঁরা সম্ভবত দ্রুত মিউটেশনের সাহায্যে বদলে যেতে থাকা আর এন এ ভাইরাসের কার্যকলাপের চরিত্রটা ভালো করে জানেন না, আজকের নভেল করোনাভাইরাস  এ ধরনের ভাইরাসেরই এক নমুনা। আমরা যত দ্রুত ভ্যাকসিন বানাই না কেন, এরা তার থেকেও দ্রুত গতিতে বদলে গিয়ে তার চোখে ধুলো দিতে সক্ষম। এর অর্থ হল, আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে হাসপাতালে বা নানা ক্লিনিকে ভ্যাকসিন নেবার জন্য দৌড়োদোড়ি করা, আর এমন এক বিশ্বাসে বুঁদ হয়ে থাকা যে এটা আমাকে রাতারাতি ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচার ক্ষমতা এনে দেবে, এটা মোটে বিবেচকের মতো কাজ নয়। এ কথাটা গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ করে ঠিক এই মুহূর্তে, যখন অজস্র সংক্রমিত মানুষ চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং সংক্রমণ ছড়াচ্ছে।

মনে রাখা দরকার, এমনও ঘটতে পারে যে, কেউ কেউ হয়তো ভ্যাকসিন নিলেন কিন্তু উদ্দিষ্ট অনাক্রম্য ক্ষমতা তৈরি হল না, এমনকি দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার বহু মাস পরেও  না।

সমস্ত ভ্যাকসিনই ব্যবহৃত হচ্ছে কেবল জরুরি ভিত্তিতে। দেশজোড়া নানা রকম ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে এগুলোর কোনটা কেমন কাজ করে   সে ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না। কাজেই ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেই সম্পূর্ণ ইমিউনিটি পেয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখা ঠিক হবে না। প্রকৃত ঘটনা হল, দু ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও বহু মানুষ সংক্রমিত হচ্ছেন।

আরও একটা কথা মনে রাখা দরকার, যারা একবার রোগে ভুগেছেন, তাদেরও আবার সংক্রমণ ঘটছে, কারণ আপাতদৃষ্টিতে প্রথমবার সংক্রমণের পরেও তাঁদের শরীরে স্বাভাবিক ইমিউনিটি তৈরি হয়নি। কাজেই স্বাভাবিক ইমিউনিটি বা ভ্যাকসিন নেওয়ার মধ্য দিয়ে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তোলার কাজটা আগে যতটা কঠিন ভাবা হয়েছিল তার থেকেও অনেক কঠিন, বিশেষ করে এই ঝড়ের বেগে মিউটেশন ঘটতে থাকা ভাইরাসটির বিরুদ্ধে।

কাজেই সুরাহা পাওয়ার জন্য আপাতত সবথেকে সেরা কাজটা হল নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখা এবং শরীরে ভাইরাস ঢুকলে তারপর তা বিনাশ করব এই ভাবনা ত্যাগ করা। কীভাবে এ কাজটা ঠিকঠাক করা সম্ভব সেটা বের করতেও হয়তো আমাদের এখনও বহুদিন লেগে যাবে।

ঠিকঠাক সুফল পেতে হলে কোনো জনগোষ্ঠীকে ভ্যাকসিন দিতে হবে যখন সংক্রমণের হার থাকে খুবই কম। কেন? কারণ, প্রথমত, এই অবস্থায় ভাইরাসটা কিছুটা নিষ্ক্রিয় অবস্থায়  থাকে, ভ্যাকসিন যারা পাচ্ছে তারা সংক্রমিত থাকে না। দ্বিতীয় কারণ হল, ভ্যাকসিন নিতে গিয়েই সংক্রমিত হবার আশঙ্কা থাকে কম।

ভারতে সংক্রমণের মাত্রা খুব নীচে নেমে এসেছিল ২০২০র ডিসেম্বর নাগাদ এবং এ বছর মার্চের শেষ অবধিও ওরকম ছিল। তার অর্থ, ভ্যাকসিনের মাধ্যমে এই দ্বিতীয় ঢেউ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য আমরা তিনটে মাস সময় পেয়েছিলাম। ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য আমাদের যে বিরাট পরিকাঠামো আছে, তা কাজে লাগিয়ে আমাদের জনসংখ্যার অধিকাংশকেই এই সময়ের মধ্যে ভ্যাকসিন দিয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল।

ঠিক এই সময়টাতেই আমাদের অবেহেলার মুখে পড়তে হল। আমরা ৬ কোটি মানুষকে কেবল ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ দিতে পেরেছি, যা আমাদের মোট জনসংখ্যার ৪ শতাংশ মাত্র। আমাদের দেশের বিপুল জনসংখ্যার সাপেক্ষে এই সংখ্যাটা কিছুই নয়, ফলে সংক্রমণের বাড়াবাড়িও ঠেকানো যায়নি।

এটাও বোঝা গেল না কেন আমরা ভ্যাকসিন তৈরি আর ভ্যাকসিন সংগ্রহের দিকে নজর না দিয়ে ‘ভ্যাকসিন ডিপ্লোম্যাসি’র মোহে পড়লাম। ভারতে যখন এইসব প্রতিষেধকের জন্য হাহাকার চলেছে তখন ৬৬ মিলিয়ন ইউনিট ভ্যাকসিন পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে অন্য দেশে। ফাইজার, মডার্না বা জনসন অ্যান্ড জনসনের ভ্যাকসিনগুলো ব্যাপক ব্যবহৃত এবং আরও বেশি কার্যকর হওয়া সত্ত্বেও সেগুলো আমদানির কোনও চেষ্টা চোখে পড়েনি। আমাদের কোনো সুপরিকল্পিত ভ্যাকসিন প্রোগ্রামও গড়ে তোলা হয়নি, দ্বিতীয় ঢেউ আসার আগেই ভারতের অধিকাংশ মানুষকে সুরক্ষিত করার জন্য সেটা জরুরি ছিল।

ভ্যাকসিনের এই চলতি সংকট জনসাধারণের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলবে। এই সংকট আরও বাড়বে কারণ ১৮-৪৫ বছর বয়ঃসীমার জনসাধারণ, যারা আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ, তারা এখন ভ্যাকসিনের প্রত্যাশী। অথচ প্রথম ডোজ নেওয়ার পর যাঁরা দ্বিতীয় ডোজের প্রতীক্ষা করছেন, তাঁদের অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং তাঁদের মধ্যে থাকবেন স্বাস্থ্যকর্মী, গুরুত্বপূর্ণ গণপরিষেবার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা, কো-মরবিডিটি যুক্ত জনসাধারণ এবং বয়স্ক নাগরিকরা। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যাপার, কারণ কেবল প্রথম ডোজ থেকে দ্রুত বাড়তে থাকা ভাইরাসের হাত থেকে যথেষ্ট প্রতিরক্ষা মেলে না। এবং ঠিক সময়মতো দ্বিতীয় ডোজটা না পেলে প্রাথমিক ভাবে যে স্বল্প মাত্রার অ্যান্টিবডি শরীরে তৈরি হয়েছিল তাও ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকবে। তা ছাড়াও শরীরে স্থায়ী ইমিউনোলজিক্যাল স্মৃতি তৈরি হওয়ার জন্য প্রথম ডোজের ফলে  কোষে যে ইমিউনিটি সূচিত হয়েছিল তার ওপরেও প্রভাব পড়বে। কাজেই ভাইরাসটাকে ভালোমতো নিষ্ক্রিয় করার জন্য আমাদের শরীরে ইমিউনিটির মাত্রাকে বাড়িয়ে তোলা আবশ্যক এবং তার উপায় হল দ্বিতীয় ডোজের ভ্যাকসিন।

আরও কথা আছে। যে মানুষরা দ্বিতীয়  ডোজের ভ্যাকসিন পেলেন না, তাঁরা যদি সংক্রমিত হন, এবং বিশেষ করে দ্বিতীয় তরঙ্গে যে মারাত্মক চরিত্রের ভ্যারিয়েন্ট দেখা দিয়েছে তার দ্বারা সংক্রমিত হন, তাহলে ভাইরাসটা হয়তো নিরীহ ইমিউন প্রতিরক্ষার বেড়া কাটিয়ে এমন জোরালো এক ধরনের জন্ম দেবে যেটা আমাদের ইমিউন ব্যবস্থাকে এড়াতে আরও বেশি দক্ষ। সেটা যদি ঘটে, তাহলে ওরকম স্ট্রেনের মোকাবিলা করা কঠিন হবে এবং তার থেকেই দেখা দেবে নতুন আর একটা সংক্রমণ তরঙ্গ।

ভ্যাকসিন দেওয়া জরুরি, কিন্তু তা করতে গিয়ে সর্বত্র যখন এই ভাইরাস ছড়িয়ে রয়েছে তখন বেশি বেশি করে তরুণ-তরুণীদের বের করে আনলে তাদেরও এইসব নতুন ভয়ঙ্কর স্ট্রেনগুলোর সামনে ফেলে দেওয়া হবে। লোক জড়ো করে ভ্যাকসিন দেওয়ার কাজটা ভীষণ সাবধানে করা দরকার। যথেষ্ট ভ্যাকসিনের সরবরাহ রাখা দরকার এবং পারস্পরিক দূরত্ববিধি মেনে চলা দরকার। দুর্ভাগ্যবশত এর কোনওটার দিকেই দৃষ্টি দেওয়া হচ্ছে না।

আরেকটা জিনিস আমরা দেখেও দেখি না। আমাদের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টারা সরকারকে একটা অতি জরুরি কাজে উদ্বুদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন, সেটা হল অজস্র সংখ্যক মিউট্যান্ট এবং ভ্যারিয়েন্টের জিনোম সিকোয়েন্স বের করা। এ থেকে আমরা বুঝতে পারতাম ঠিক কত ধরনের ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট এই মুহূর্তে সক্রিয় আছে এবং একই সঙ্গে জানতে পারতাম  তাদের উৎস এবং তাদের রোগপ্রভাবের মাত্রা। তার ফলে রোগ সংক্রমণের সংযোগসূত্রগুলোর হদিশ আরও ভালোভাবে পাওয়া যেত। দুর্ভাগ্যবশত এ কাজটা যখন করা দরকার ছিল তখন আমরা তাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করিনি।

আজ আমরা জানি না ভাইরাসটার কতগুলো ভ্যারিয়েন্ট রয়েছে এবং তাদের সংক্রমণ বা প্রাণনাশের ক্ষমতা কতদূর। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রক মহল এ ব্যাপারে হয় চুপচাপ বসে আছে নয়তো ভাইরাসটা নিয়ে যেসব গবেষণা জরুরি তার উদ্যোগ নিতে বিলম্ব করে চলেছে। এ ধরনের গবেষণার ফলাফল হাতে না থাকলে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার পরিমাপ করা ভারি দুরূহ, এবং চলতি ভ্যাকসিন প্রকল্প থেকে আমাদের যা প্রত্যাশা তা মেটানোও ভারি কঠিন।

কাজেই ভ্যাকসিন দেওয়া হোক বা না হোক, এই অতিমারীর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার একমাত্র উপায় ভাইরাসটা থেকে দূরে থাকা, কারণ আমরা যত এটার মুখোমুখি হব বা এটাকে শরীরে ডেকে আনব, তত আমরা অমূল্য প্রাণ হারাব এবং সেই সঙ্গে এটাকে আরও বেশি করে মিউটেটেড হওয়ার সুযোগ দেব। বলা বাহুল্য সেটা সামলানো তখন আরও কঠিন হয়ে পড়বে। অতএব আমাদের ঘরের ভেতরেই থাকতে হবে, নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে হবে, বাইরের কিছুর সঙ্গে সংস্পর্শ ঘটলেই বীজাণুনাশক ব্যবহার করতে হবে। আমরা সকলেই বাঁচব, না সদলে নিশ্চিহ্ন হব জানি না, কিন্তু সমস্ত নাগরিক যতক্ষণ না এই অভ্যাস রপ্ত করছেন এবং এই নির্দেশগুলো মেনে চলছেন, এর হাত থেকে মুক্তি নেই। নান্য পন্থা।

[অনুবাদ: যুধাজিৎ দাশগুপ্ত]

রচনাটি Shot in the dark শিরোনামে The Telegraph Online পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে ৯ মে ২০২১ তারিখে। কৌস্তুভ পান্ডা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গুহ সেন্টার ফর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের জীবরসায়নবিদ্যার অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান

মহামারীর সুযোগে পরিবেশ-হননের ছাড়পত্র

ঠিক যে-সময়ে কোভিড-১৯ অতিমারীর কারণে সাধারণ মানুষের পক্ষে পরিবেশ-সুরক্ষার ওপর নজরদারি চালানো দুষ্কর হয়ে পড়েছে, জরুরি সরেজমিন সমীক্ষাগুলোও চালানো যাচ্ছে না ঠিক, তখনই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পরিবেশ-পর্যালোচনার নীতিগুলোকে শিথিল করে বড় বড় শিল্পপ্রকল্পগুলোকে ছাড়পত্র দেওয়ার উদ্যোগ নিল। ভারতের পরিবেশবাদীরা এর বিরুদ্ধে সমালোচনায় সরব হয়েছেন।

‘‘সরকারের ভাবটা এমন যেন এই মুহূর্তে জনস্বাস্থ্য আদৌ কোনও সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে না, তারা এরই মধ্যে মিটিং ডাকছে, সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বড় বড় প্রকল্পগুলো সমেত অন্যান্য উদ্যোগ সম্পর্কে’’, বলেছেন কাঞ্চী কোহলি, পরিবেশ-পরিচালন বিশেষজ্ঞ, ‘‘অথচ জনগণ যাতে ব্যাপারগুলোর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, যাতে সরেজমিনে অবস্থা যাচাই করা যায়, তার সমস্ত সুযোগ আগে থাকতেই বন্ধ।’’ কাঞ্চী কোহলি সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এর সঙ্গে যুক্ত আছেন।

অতিমারীর প্রকোপ কমানোর জন্য ২৬ মার্চ থেকে ভারত কঠোর লকডাউন অবস্থার মধ্যে রয়েছে। কিন্তু মিনিস্ট্রি অফ এনভায়রনমেন্ট, ফরেস্ট অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ-এ কাজকর্ম চলেছে যথারীতি। সেখানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিভিন্ন প্যানেলের নানা বৈঠক সারা হয়েছে যাতে খনি, পরিকাঠামো আর শিল্পকারখানা গড়ার একঢাল প্রকল্পকে ছাড় দেওয়া যায়।  গত কয়েক মাসের মধ্যে এই মন্ত্রক একটা হস্তী সংরক্ষণ অরণ্যে নতুন কয়লাখনি খোঁড়ার ছাড়পত্র দিয়েছে, তৈলকূপের জন্য প্রাথমিক ড্রিলিং-এর অনুমতি বিলানো হয়েছে এমন জায়গায় যা লায়ন-টেলড ম্যাকাক নামে বিপন্ন বানর আর গ্রেট ইন্ডিয়ান হর্নবিলের বাসভূমি। সেইসঙ্গে ছাড় পেয়েছে নয়াদিল্লির পার্লামেন্ট অঞ্চলটিকে ঢেলে সাজানোর বিতর্কিত পরিকল্পনাটি। আরও দুটো বিতর্কিত প্রকল্প নিয়ে এখন নাড়াচাড়া করা হচ্ছে: অরুণাচল প্রদেশের দিবাং ভ্যালি, যা বায়োডাইভার্সিটির ‘হটস্পট’, সেখানে একটা বিশাল জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, আর মধ্য ভারতের একটা ব্যাঘ্র প্রকল্পের ভেতর ইউরেনিয়াম খনি-প্রকল্প।

মন্ত্রকটি এইসঙ্গে ভারতের পরিবেশ সংক্রান্ত আইনের বেশ কয়েকটাকে ঢেলে সাজানোর দিকে এগোচ্ছে। বড় বড় প্রকল্প থেকে পরিবেশের সম্ভাব্য ক্ষতি পর্যালোচনার ব্যাপারে একটা নতুন খসড়া নীতি পেশ করা হয়েছে এ বছর ২৩ মার্চ তারিখে। এই খসড়ায় আরও অনেক প্রস্তাবের সঙ্গে এটাও যোগ করা হয়েছে যে, পরিবেশ পর্যালোচনার ওপর জনসাধারণের মন্তব্য জানানোর জন্য বরাদ্দ সময় কমিয়ে দেওয়া হবে। শুধু তাই নয়, তারও বেশি সংখ্যক প্রকল্পকে একেবারে জনমতের মুখোমুখি হওয়ার প্রক্রিয়াটা থেকেই রেহাই দেওয়া হয়েছে। এই প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলোর বিপক্ষ সমালোচকদের মত হল, এর ফলে যেসব প্রকল্প পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়াই কাজ শুরু করেছে তাদের প্রকারান্তরে অনুমতি দিয়ে দেওয়া হল।

মন্ত্রকটি এইসঙ্গে ভারতের পরিবেশ সংক্রান্ত আইনের বেশ কয়েকটাকে ঢেলে সাজানোর দিকে এগোচ্ছে। বড় বড় প্রকল্প থেকে পরিবেশের সম্ভাব্য ক্ষতি পর্যালোচনার ব্যাপারে একটা নতুন খসড়া নীতি পেশ করা হয়েছে এ বছর ২৩ মার্চ তারিখে। এই খসড়ায় আরও অনেক প্রস্তাবের সঙ্গে এটাও যোগ করা হয়েছে যে, পরিবেশ পর্যালোচনার ওপর জনসাধারণের মন্তব্য জানানোর জন্য বরাদ্দ সময় কমিয়ে দেওয়া হবে। শুধু তাই নয়, তারও বেশি সংখ্যক প্রকল্পকে একেবারে জনমতের মুখোমুখি হওয়ার প্রক্রিয়াটা থেকেই রেহাই দেওয়া হয়েছে। এই প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলোর বিপক্ষ সমালোচকদের মত হল, এর ফলে যেসব প্রকল্প পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়াই কাজ শুরু করেছে তাদের প্রকারান্তরে অনুমতি দিয়ে দেওয়া হল।

বিশ্লেষকদের মতে অতিমারী চলার মধ্যেই সরকারের তরফে শিল্পোদ্যোগের প্রকল্পগুলোকে এভাবে ঠেলে পার করে দেওয়ার চেষ্টাটি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাণিজ্যমহল-ঘেঁষা অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। যেমন, লিগ্যাল ইনিশিয়েটিভ ফর ফরেস্ট অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট সংস্থার বিশ্লেষণে ধরা পড়েছে, ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি এবং পার্কগুলির তত্ত্বাবধায়ক একটি বিশেষ প্যানেল ২০১৯-এর জানুয়ারি থেকে জুনের ভেতর ৭০টা উন্নয়ন প্রকল্পের ৬৩টাকেই ইতিমধ্যে ছাড় দিয়েছে, পরিণামে ২১৬ হেক্টর আয়তন প্রাকৃতিক ভূমিতে সংরক্ষণের অবনতি ঘটেছে। কোহলি উল্লেখ করেছেন, এই প্যানেলের মধ্যে কেবল মাত্র একজনই বিজ্ঞানী আছেন যিনি স্বাধীন। শ্রীমতী কোহলির মতে, ‘‘নানারকম দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ধারা কয়েক বছর হল ক্ষীণ হয়ে এসেছে।’’ তিনি বলেন, ‘‘প্রধান লক্ষ্য এখন ছাড় পাইয়ে দেওয়া, অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ বা মতবিনিময় চালু করা নয়।’’

কনজারভেশনিস্ট এবং বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, দিবাং ভ্যালি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বেলাতেও উন্নয়নমুখী দৃষ্টিভঙ্গিই প্রাধান্য পাবে। ৩০৯৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষম এই প্রকল্পটির জন্য প্রস্তাবিত জলাধারটি যেখানে তৈরি হবে সেখানে ৩০০ প্রজাতির পাখি, ৭৫টি প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর বাস। এখানকার অধিবাসী ইদু-মিশমি উপজাতির মানুষেরা এই প্রকল্পটির বিরোধিতা করছেন। এই অঞ্চলে এর আগে সরকারের তরফে একটা পরিবেশ-বিনাশ সম্ভাবনার পর্যালোচনা করা হয়েছিল। এই অঞ্চলে যেসব বিজ্ঞানী গবেষণা করছেন তাঁরা সেই প্রতিবেদনটিকে খুঁটিয়ে দেখেছেন। তাঁদের সুপারিশ হল, এখানে আরও বড় মাপে একটা পর্যালোচনা হওয়া উচিত, যা এই বাঁধটি এবং এটির মতো এখানে আরও যেসব বাঁধের পরিকল্পনা করা হয়েছে সেগুলো কীভাবে পরিবেশের ওপর কুপ্রভাব ফেলতে পারে তার অনুসন্ধান করবে। অরণ্যের দেখভাল ও পরিচালনার ব্যাপারে এখানকার ভূমিপুত্রদের মতামতকে আরও বেশি করে গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারে এই বিজ্ঞানীরা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে আসছেন। এই বিজ্ঞানীদের একটি গোষ্ঠী অরণ্য বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটিকে গতমাসে একটি লিখিত আবেদনে জানিয়েছে, ‘‘আমাদের সনির্বন্ধ অনুরোধ, এই দিকটাও ভেবে দেখুন’’, যাতে ‘‘এই নজিরবিহীন সামাজিক আর প্রাকৃতিক সংকটের মুহূর্তে ভারত আবার সত্যিকারের ইকোলজিকাল চ্যাম্পিয়ন হিসেবে বিশ্বকে পথ দেখাতে পারে।’’

[অনুবাদ: যুধাজিৎ দাশগুপ্ত]

প্রতিবেদনটি ‘সায়েন্স’ পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে ‘‘India’s push to relax environmental assessment rules amid pandemic draws criticism’’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল ৭ মে ২০২০ তারিখে। doi:10.1126/science.abc6828

কোন মুখোশ নিরাপদ?

আমার যদি করোনা-আক্রান্ত হওয়ার কোনও লক্ষণ না থাকে তাহলেও কি মুখোশ পরা উচিত? এই প্যানডেমিকের নানা সময়ে এই কথাটাই বারে বারে ঘুরেফিরে এসেছে। এতদিন পর্যন্ত এর উত্তরটাও ছিল সরল, অন্তত যদি আমরা আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)-এর কথা মেনে চলি। ৩ এপ্রিল পর্যন্ত সিডিসি এই প্রশ্নের উত্তরে বলছিল: না, মুখোশ পরার দরকার নেই।...

কিন্তু মাস্ক সম্পর্কে সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে এখন। ৩ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাধারণ মানুষকে সিডিসি-র নির্দেশ অনুসারে নন-মেডিক্যাল মাস্ক পরতে বলেছেন। বাড়ি থেকে যদি বেরতেই হয়, যেমন ধরা যাক দোকান-বাজার করতে, তবে মাস্ক পরা জরুরি। নন-মেডিক্যাল মাস্ক মানে হল নাক ও মুখ ঢাকা কাপড়ের মুখোশ। মাথায় বাঁধা ফেট্টি, যাকে ইংরেজিতে বলে ব্যানডানা, এবং টি-শার্ট তৈরি হয় যে-কাপড়ে সেরকম কিছু দিয়ে বানানো। এই সাবধানতা সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক।...

২৬ মার্চ আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজ-এর ডিরেক্টর অ্যান্টনি ফসি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘আমরা যখন বলছিলাম যে আপনার মুখোশ পরার দরকার নেই তখন আমরা আসলে বলতে চাইছিলাম মুখোশ পরার প্রয়োজন কার বেশি সেটা বুঝে নিয়ে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে মুখোশ পরা উচিত। কোনও আদর্শ পৃথিবীতে, যেখানে যত চাই তত মুখোশ মেলে, সেখানে কেউ মুখোশ পরে রাস্তায় হাঁটলে আমার কোনও আপত্তি থাকতে পারে না। ওটার মাধ্যমে আপনি তো কিছুটা বেশি সুরক্ষা পেতেই পারেন।’’

প্রশ্ন হল, মাস্ক কি সত্যিই নীরোগ মানুষকে সুস্থ থাকতে সাহায্য করবে? একটা টি-শার্টের কাপড় কি আমাকে রোগের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে? উত্তরগুলো নিয়ে কিছু জটিলতা আছে, সবটা এখনও বোঝা যায়নি। চিকিৎসকরা এবং মাস্কের উপযোগিতা নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন তাঁরা কী বলছেন দেখা যাক।

বিজ্ঞানীরা জানেন, নয়া করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, কিন্তু রোগের কোনও লক্ষণ তখনও যার মধ্যে ফোটেনি এমন মানুষেরাও সংক্রমণ ছড়াতে পারেন। (এ কথাটা রোগটা যখন দেখা দিল তখন জানা ছিল না।) সিডিসি-র ডিরেক্টর রবার্ট রেডফিল্ড সম্প্রতি এক সংবাদমাধ্যম, এনপিআর-কে দেওয়া একটা সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সংক্রমিত মানুষদের শতকরা ২৫জনের ভেতর রোগের কোনও লক্ষণ নাও দেখা যেতে পারে। যাদের শরীরে রোগের লক্ষণ দেখা দিচ্ছে তারাও ওই লক্ষণ দেখা দেওয়ার দুদিন আগে থাকতেই সম্ভবত রোগটা ছড়াতে থাকেন। ‘‘রোগটা কীভাবে দেশের ভেতর এতদূর ছড়িয়েছে তার একটা কারণ বোধহয় পাওয়া যাচ্ছে এখান থেকে।’’ বলেছেন রেডফিল্ড।

রোগটার এমন নীরব পদসঞ্চারের ফলে বাইরে বেরনো সমস্ত সাধারণ মানুষের মুখোশ পরার স্বপক্ষে যুক্তিটাই ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে, কারণ কে যে সংক্রমিত আর কে যে নয় তা বোঝা যাচ্ছে না।...

দুটো মতবাদেরই – অর্থাৎ এক, প্রত্যেক সাধারণ মানুষেরই মুখোশ পরা দরকার, আর দুই, সমস্ত আমআদমির মুখোশ পরার দরকার নেই – দু’পক্ষেরই যথেষ্ট গোঁড়া সমর্থক মজুত আছে। প্রথম দলে যাঁরা, তাঁরা দেখাচ্ছেন যে, ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো রোগাক্রান্ত মানুষদের থেকে রেহাই পেতে মুখোশ ব্যবহারের সুফল আছে – তা সে সুফল যত সামান্যই হোক না কেন, আর তার বৈজ্ঞানিক প্রমাণও আছে।


দ্বিতীয় দলে যাঁরা আছেন, তাঁরা মনে করেন, বৈজ্ঞানিক সাবুদ যা মিলছে তাতে পথেঘাটে মুখোশের কার্যকারিতাকে এমন মনে হচ্ছে না যে, প্রত্যেককে তা পরতে বলাটা যৌক্তিক কাজ হবে। বরং, ওটা পরে থাকলে লোকের মনে একটা ভ্রান্ত নিরাপত্তার ভাব তৈরি হতে পারে, তারা হয়তো অকারণ সাহসী হয়ে যেসব বিধিনিষেধ আসলে জরুরি এবং কার্যকর, সেগুলোকেই অগ্রাহ্য করতে থাকবে – যেমন, প্রত্যেকের সঙ্গে দূরত্ব রক্ষা করে চলা। তাঁরা আরও মনে করেন যে, মুখোশ পরা অবস্থায় তারা হয়তো অজান্তেই অনেক বেশি করে মুখে হাত দেবেন।

কানাডার সংক্রামক রোগের গবেষক-চিকিৎসক আইজাক বোগোচ বলছেন, ‘‘আমার মনে হয় আমাদের বেশ একটু সততার সঙ্গে স্বীকার করে নেওয়া ভাল যে, কিছু কিছু প্রমাণ থেকে ইঙ্গিত মিলছে, মাস্ক পরার সম্ভাব্য সুফল আছে। কিন্তু সেই সঙ্গে বেশ কিছু সতর্কতার অবকাশও জুড়ে আছে। ... এটা ভীষণ সত্যি যে, মাস্ক পরা বহু মানুষের বেলাতেই সেটা পরার যে-সুবিধে তা নষ্ট হবে যদি সে ভুল ধরনের মাস্ক পরে, কিংবা ধরা যাক যদি সে মাস্কটা ঠিকঠাক করে বসানোর জন্যই বারবার মুখে হাত ঠেকায়। যে মানুষটা দূরত্ব রাখার সব নিয়মকানুন ঠিকঠাক মানছে, যে অন্তত ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রাখছে অন্য মানুষেোর থেকে, তার বেলা মুখোশ পরাটা অতিরিক্ত কোনও সুবিধে দেবে না।’’

আমেরিকায় প্রয়োজনীয় মাস্কেরসরবরাহ এত কম যে স্বাস্থ্যকর্মীরাই করোনাভাইরাস রোগীদের সঙ্গে কাজ করার মতো পারসোনাল প্রোটেকটিভ ইউনিট (পিপিই) পাচ্ছে না। তার মধ্যে আছে এন-৯৫ রেস্পিরেটর (শক্ত করে মুখে আঁটা যায় এমন একটা মুখোশ তাতে হাঁচি-কাশি থেকে ছিটকে বেরনো অণুবিন্দু, যাতে ভাইরাস ব্যাকটিরিয়া লেগে থাকতে পারে, আটকে যায়। কিন্তু খুব সূক্ষ্ম কিছু আটকায় না)।

‘‘আমরা জানি যে, যারা স্বাস্থ্যপরিষেবা দিচ্ছে তাদেরই সংক্রমণের সম্ভাবনা অনেক বেশি, মানে, যে ধরনের কাজ এদের করতে হয় বা যে ধরনের রোগীদের নিয়ে করতে হয় তার ভিত্তিতে বলছি।’’ বলেছেন ড. এরিকা শেনয়, তিনি ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হসপিটালের ইনফেকশন কন্ট্রোল ইউনিটের অ্যাসোসোসিয়েট চিফ। মুখোশের ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে যখন হাত ধোওয়া, চোখ সুরক্ষিত রাখা, গ্লাভস আর গাউন পরা এইসব সতর্কতা পালন করা হয়, তখন স্বাস্থ্যকর্মীরা সত্যিই সুস্থ থাকতে পারেন, যেমন সুস্থ থেকেছেন কোভিড-১৯ রোগীদের সঙ্গে কাজ করার সময়।

মুখোশের টানাটানির দরুন আমেরিকা সরকার সাধারণ নাগরিকদের যে মুখোশ পরতে বলছেন তা এন-৯৫ বা সার্জিক্যাল মাস্ক নয়, বরং ঘরে বানানো মুখোশ। তবে, যদি একসময় টানাটানি মিটেও যায়, সকলে মুখোশ পরতেও পারে, তাতে সুরক্ষা আদৌ আসে কি না সেটাও জেনে নেওয়া দরকার।

আমাদের শ্বাসব্যবস্থাকে আক্রমণ করে এমন ভাইরাস আটকাতে সার্জিক্যাল মাস্ক কতটা কার্যকর তা নিয়ে বেশ কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছে। ‘‘এগুলোতে ধরা পড়েছে যে, অল্প কিছু সুফল এর সত্যিই আছে এবং মাস্ক পরার তেমন কোও ক্ষতিকর প্রভাবও নেই।’’ বলেছেন অ্যালিসন আয়েলো, ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ক্যারোলিনাতে এপিডেমিওলজির অধ্যাপক।২০১০-এ মুখোশের উপযোগিতা সংক্রান্ত একটা গবেষণাপত্রের তিনি সহলেখক। তাঁর করা একটা গবেষণার ফলাফল দেখাচ্ছে, ফ্লু চলছে এমন এক সময়ে কলেজের ছাত্রছাত্রীদের ওপর মাস্ক পরার তেমন কার্যকারিতা এমনিতে দেখা যায়নি, সুফল দেখা গেছে যখন মাস্ক পরার সঙ্গে সঙ্গে নিয়ম মেনে তারা হাতও ধুয়েছে।

২০০৯-এ প্রকাশিত আর-একাট গবেষণা হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ায়। ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো রোগে আক্রান্ত বাচ্চাদের দেখাশোনা করার সময় পরিবারের সদস্যরা যখন নিয়ম করে মুখোশ পরেছেন, দেখা গেছে তাঁরা নিজেরা কম আক্রান্ত হয়েছেন।

সিডিসি সম্প্রতি জানিয়েছে, চিকিৎসা-মানের মাস্ক যদি না পাওয়া যায় তাহলে স্বাস্থ্যকর্মীরা ঘরে তৈরি মুখোশ ব্যবহার করতে পারে, যেমন মাথায় বাঁধা ফেট্টি অর্থাৎ ব্যানডানা এবং স্কার্ফ। ‘‘অবশ্যই ঘরে তৈরি মাস্ককে পিপিই বলা চলবে না, কারণ সেগুলো কতটা সুরক্ষা দেয় তা এখনও অজানা।’’ এরকম জিনিস ব্যবহার করার সময় অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

ঘরে তৈরি মাস্ক আদপে নিরাপদ কি না তা নিয়ে ২০১৩য় একটা সমীক্ষা হয়েছিল। গবেষকরা ঘরেই মেলে এমন নানা কিছু দিয়ে মুখোশ বানিয়ে দেখছিলেন সেগুলো ব্যাকটেরিয়া আর ভাইরাস যুক্ত এরোসল (বাতাসে ভাসমান সূক্ষ্ম কণা) কতটা আটকাতে পারে, এবং  সেই জিনিস দিয়ে বাস্তবে ব্যবহারোপযোগী মুখোশ কীভাবে বানানো যেতে পারে। তাঁদের পরীক্ষিত জিনিসগুলোর মধ্যে ছিল সুতির টি-শার্ট, স্কার্ফ, চা-পানের সময় ব্যবহৃত ছোট তোয়ালে, বালিশের ওয়াড়, ভ্যাকুয়াম ক্লিনারে ব্যবহৃত থলে। তাঁরা দেখলেন, সবথেকে কার্যকর মুখোশ বানানো যায় ১০০%  সুতির টি-শার্ট দিয়ে কিংবা বালিশের ওয়াড় দিয়ে। তবে, টি-শার্টের কাপড়ের স্ট্রেচি-ভাবের কারণে তা দিয়ে বানানো মুখোশটা পরতে সুবিধে হয়। স্বেচ্ছাকর্মীরা টি-শার্ট দিয়ে নিজেরাই মুখোশ বানিয়ে (কীভাবে বানানো যায় তার উপায় দেখানে আছে এই রচনায়) তার মধ্য দিয়ে কেশে দেখছিলেন সেটা কেমন কাজ করে। তুলনার জন্য একইভাবে কাশির ফলাফল দেখা হয়েছিল সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার করে এবং কোনও মাস্ক ছাড়াই। দেখা গেছে ছোট ছোট সংক্রামক কণা আটকানোর কাজে টি-শার্ট দিয়ে বানানো মাস্ক সার্জিক্যাল মাস্কের মাত্র তিন ভাগের একভাগ কার্যকর।... ‘‘কিছু না থাকার চেয়ে এটা থাকা ভাল’’, বলেছেন আনা ডেভিস, এই গবেষকদলের একজন, তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন রিসার্চ কো-অর্ডিনেটর।

... তবে ঘরে তৈরি মাস্কে যে হিতে বিপরীত হতে পারে তেমন সম্ভাবনাও দেখা গেছে। অস্ট্রেলিয়ায় করা এক গবেষণায় দেখা গেছে মাস্ক ব্যবহারকারীরা যতটা নিয়ম মেনে তাদের মাস্কগুলো ধোয়ার কথা ছিল তেমনটা করেননি। রায়না ম্যাকইনটায়ার, অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে ইউনিভার্সিটি অফ নিউ সাউথ ওয়েলসের অধ্যাপক এবং উপরোক্ত গবেষণার সহযোগী, বলছেন, ‘‘আমরা জানতে পেরেছি মাস্কগুলো ভীষণ স্যাঁতসেঁতে, ভিজে ভিজে হয়ে পড়ে।’’ এবং ‘‘ভিজেভাবের কারণে সেখানে রোগজীবাণু বাড়তে থাকে। কাজেই লোকেরা যদি সেটা ঠিকঠাক না ধুয়ে ব্যবহার করে চলে তাহলে সংক্রমণের সম্ভাবনা তো থেকেই যায়। সাধারণ মানুষ যদি ঘরে তৈরি মাস্ক ব্যবহার করতেই চায় তাহলে তাতে একাধিক স্তর রেখে বানানো ভাল, এবং এমন কাপড় ব্যবহার করা উচিত যা জল টানে না।ব্যাপারটা এখনও অপরিষ্কার, কিন্তু আইয়েলো বলছেন, ‘‘কাপড়টা যেহেতু কিছুটা হলেও রোগ-ছড়ানো অণুবিন্দু ঠেকাতে পারে, কাজেই অন্তত খাতায়-কলমে ওই আড়ালটা সঙ্গে রাখাই ভাল, তাতে কোনও কোনও পরিস্থিতিতে কিছু কিছু সংক্রমণ তো আটকানো যেতেই পারে।’’

‘‘মুখোশ যদি পরতেই চাও তো পরো,’’ বোগোচ বলছেন, ‘‘কিন্তু এ থেকে সম্ভাব্য কী উপকার পাওয়া সম্ভব সেটা যেমন মনে রাখতে হবে তেমনই এর সীমাবদ্ধতাগুলো কী কী, জানতে হবে সেটাও। আর বাস্তববোধটাকে সজাগ রাখতে হবে।’’

[অনুবাদ: যুধাজিৎ দাশগুপ্ত]

ShouldHealthy People Wear Masks to Prevent Coronavirus? The Answer May Be Changing শিরোনামে এই রচনাটা বেরিয়েছে ৩ এপ্রিল ২০২০, টাইম পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে। এখানে তার নির্বাচিত অংশের অনুবাদ আছে

মুখোশ পরব, কি পরব না

করোনাভাইরাস কি বাতাস বেয়ে সংবাহিত হতে পারে? ক’দিন আগে থাকতেই, যখন থেকে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে যে, মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাস খুব দ্রুত ছড়াচ্ছে, গবেষকরা এটার উত্তর খুঁজে চলেছেন। স্বাস্থ্য অধিকর্তারা বলছেন এটা কেবল কাশি বা হাঁচির সঙ্গে ছিটকে বেরনো অণুবিন্দু মারফতই প্রবাহিত হয় - হয় সরাসরি, নয় কোনও বস্তুতে লেগে থেকে। কিন্তু বেশ কিছু বিজ্ঞানী বলছেন, বাতাস মারফত করোনাভাইরাস সংবাহিত হওয়ার প্রাথমিক প্রমাণও মিলেছে। আমাদের নিশ্বাসবায়ুতে মিশে থাকা অনেকগুণ সূক্ষ্মতর কণা, যাকে বলে এরোসল, তার মধ্য দিয়েও এটা ছড়িয়ে পড়তে পারে। যদি সাবধানতা অবলম্বন করা যায়, যেমন ঘরের ভেতর বায়ু চলাচল বাড়ানো, তবে সংক্রমণের আশঙ্কা কমানো যেতে পারে।

২৭ মার্চ তারিখে একটা বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদনে ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশন (হু) জানিয়েছে, সার্স-কভ-টু-র বায়ুবাহিত ভাইরাস, এমন মতের স্বপক্ষে পর্যাপ্ত প্রমাণ কিছু নেই। চিকিৎসা-প্রক্রিয়ার কিছু বিশেষ অবস্থায়, যেমন যখন সংক্রামিত রোগীকে কোনও টিউব পরানো হচ্ছে, তেমন সম্ভাবনা অবশ্য থেকে যেতে পারে।

যে-বিশেষজ্ঞরা বায়ুবাহিত শ্বাসঘটিত ব্যাধি এবং এরোসলের সম্পর্ক নিয়ে কাজ করেন তাঁরা বলছেন, করোনাভাইরাসের বায়ুবাহিত চরিত্রের সর্বজনগ্রাহ্য প্রমাণ জোগাড় করতে কয়েক বছর হয়তো লেগে যাবে, আর তার মাঝখানে হয়তো বহু প্রাণ বিনষ্ট হবে। ‘‘নিখুঁত প্রমাণ পাওয়ার তাগিদ যেন ব্যাপারটা সম্যক বুঝে নেওয়ার পথে কাঁটা হয়ে না দাঁড়ায়,’’ বলেছেন মাইকেল ওস্টারহোলম, মিনিয়াপোলিসের মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ইনফেকশাস-ডিজিজ এপিডেমিওলজিস্ট।

‘‘যে-বিজ্ঞানীরা এ নিয়ে কাজ করে চলেছেন তাঁদের মনের মধ্যে তিলমাত্র সন্দেহ নেই যে ভাইরাসটা বাতাস বেয়ে ছড়ায়’’, বলছেন লিডিয়া মোরাওস্কা, অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে কুইনসল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজির এরোসল সায়েন্টিস্ট।

জনস্বাস্থ্য আধিকারিকরা যখন বলছেন যে, কোভিড-১৯ বায়ুবাহিত এমন কোনও প্রমাণ নেই, তখন তাঁরা বোঝাতে চাইছেন ভাইরাস-মাখা কিছু কণা যেগুলোর মাপ ৫ মাইক্রোমিটারেরও কম, যাকে বলে এরোসল, সেসবের বাতাসে ভেসে পরিবাহিত হওয়ার কথা। যেসব বিন্দু তুলনায় বড়সড়, সেগুলো কারও হাঁচি বা কাশি থেকে বেরিয়ে এসে সামান্য গিয়েই মাটিতে বা অন্য কোনও বস্তুর ওপর পড়ে আটকে যায়, এটাই সাধারণ ধারণা। ওদিকে এরোসলগুলো বাতাসে ভেসে থাকতে পারে এবং অনেকদূর অবধি যেতে পারে।

বেন কাউলিং হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন এপিডেমিওলজিস্ট। তাঁর মতে, বেশিরভাগ সংক্রমণই খুব কাছাকাছি পাল্লার মধ্যে ঘটে। কিন্তু অণুবিন্দু আর এরোসলের মধ্যে ফারাক করলে খুব একটা লাভ হবে না। কেননা, ‘‘ভাইরাস সঙ্গে নিয়ে যেসব কণা বেরিয়ে আসে সেগুলো নানা মাপের হয়। বড়, খুব বড় থেকে একেবারে এরোসলের মতো সূক্ষ্ম কণা অবধি।’’

আর, সার্স-কভ-টু যদি এরোসল পরিবাহিত হতে পারে তবে এ-ও খুবই সম্ভব যে, আবদ্ধ জায়গায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো ক্রমশ জমে উঠতে পারে কিংবা অনেকদূর অবধি পরিবাহিত হতে পারে।

কথা বলা বা নিশ্বাস ছাড়ার সময়েই এরোসলগুলো বেশি করে তৈরি হয়। কাজেই তা হাঁচি বা কাশির থেকেও বেশি বিপজ্জনক। এই মত ব্রিটেনের ইউনিভার্সিট অফ লেস্টার-এর ভাইরোলজিস্ট জুলিয়ান ট্যাং-এর: ‘‘কেউ যখন কাশে, বা হাঁচি দেয়, তখন একটু মুখ ফিরিয়ে নেয়।’’ কিন্তু আমরা যখন কথা বলি বা নিশ্বাস ছাড়ি তখন তো সেটা আর করি না।

ইনফ্লুয়েঞ্জা-আক্রান্ত মানুষদের নিয়ে করা কিছু পরীক্ষায় দেখা গেছে রোগীদের ৩৯ শতাংশই সংক্রামক এরোসল ত্যাগ করছে। আমরা যখনই কারও সঙ্গে একই বাতাসে নিশ্বাস নিই, তারা যে বাতাস ত্যাগ করছে সেটাই আমরা শ্বাসের সঙ্গে টেনে নিই, তখনই বাতাসবাহী সংক্রমণ সম্ভব হয়ে ওঠে।

প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ এবং ক্ষেত্রসমীক্ষা থেকে এরোসল বেয়ে সার্স-কভ-টু ছড়ানোর স্বপক্ষে মিশ্র প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। চিনের উহানে যখন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব তুঙ্গে, তখন উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজিস্ট কে. ল্যান, কোভিড-১৯-এর রোগীরা চিকিৎসাধীন রয়েছে এমন হাসপাতাল থেকে এরোসলের নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন। সেইসঙ্গে এরোসল নিয়েছিলেন দুটো জমজমাট ডিপার্টমেন্ট স্টোরের প্রবেশপথ থেকেও।

ল্যান এবং তাঁর সতীর্থদের লেখা একটা রিপোর্ট (প্রাক-মুদ্রণ অনলাইন প্রকাশ, রিভিউ হয়নি সেটার) বলছে, তাঁরা বেশ কয়েকটি জায়গা থেকে সার্স-কভ-টু-র আরএনএ পেয়েছেন, ডিপার্টমেন্ট স্টোরগুলো থেকেও।

তবে এই পরীক্ষাগুলোয় নিশ্চিত বোঝা যাচ্ছে না এইসব সংগৃহীত এরোসল আমাদের কোষে সংক্রমণ ঘটাতে পারে কিনা। ‘নেচার’ পত্রিকাকে লেখা এক ই-মেলে ল্যান জানিয়েছেন যে, এই গবেষণা দেখাচ্ছে, ‘‘কথা বলা বা শ্বাস ছাড়ার সময় এরোসলের মধ্য দিয়ে সার্স-কভ-টু-র সঞ্চারসম্ভব হলেও হতে পারে, এবং উৎস থেকে কাছে বা দূরে থাকা মানুষের ওপর তার প্রভাবও পড়তে পারে।’’ সাবধান থাকার জন্য সাধারণ মানুষের পক্ষে ভিড় এড়িয়ে চলাই উচিত হবে, তিনি বলেছেন। এবং সবসময় মুখোশ পরা উচিত, যাতে ‘‘বায়ুবাহিত ভাইরাস থেকে সংক্রমণের ঝুঁকি কমে।’’

সিঙ্গাপুরে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের অস্থায়ী আবাসে যেসব আইসোলেশন রুম ছিল তার বাতাসে সার্স-কভ-টুর সন্ধান করেছিল আর-একটা সমীক্ষা। সেখানে বাতাস বেরনোর পথে রাখা একটা পাখার গা থেকে ভাইরাসটির উপস্থিতি মিলেছিল। তবে, ওই সমীক্ষার সঙ্গে যুক্ত দুজন গবেষক, সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল সেন্টার ফর ইনফেকশাস ডিজিজের কালীশ্বর মরিমুথি এবং উন টেক এং, নেচার পত্রিকাকে পাঠানো এক ই-মেলে জানিয়েছেন যে, একজন রোগী ওই পাখাটার এত কাছাকাছি ছিলেন যে তাঁর হাঁচি-কাশি থেকে ছিটকে আসা অণুবিন্দু থেকেও সেটা ঘটে থাকতে পারে।

নেব্রাস্কায় আর-এক গবেষকদল তাঁদের সংগৃহীত বাতাসের দুই-তৃতীয়াংশ নমুনায় ভাইরাসের আরএনএ পেয়েছেন। বিভিন্ন হাসপাতালে কোভিড-১৯-এ মারাত্মক রকমে আক্রান্ত মানুষদের এবং সেইসঙ্গে বিভিন্ন কোয়ারান্টিনে হালকা আক্রান্ত মানুষদের যেসব আইসোলেশন রুমে রাখা হয়েছিল সেখান থেকে বাতাস নিয়েছিলেন তাঁরা। বাতাস ঢোকা-বেরনোর পথে যে-জাফরি রাখা ছিল তার গা থেকেও মিলেছে ভাইরাসের লক্ষণ। তবে সেসব জায়গা থেকে পাওয়া কোনও নমুনাই মানুষের কোষকে সংক্রমিত করতে পারেনি। কিন্তু পরীক্ষার মাপজোখ বলছে, ‘‘কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের দ্বারা ভাইরাল এরোসল নিঃসরণ সম্ভব, এমনকী কাশি না থাকলেও’’, বলেছেন এই গবেষকরা।

হু যে বৈজ্ঞানিক বিবৃতি জারি করেছে তার বক্তব্য হল, এখনও অবধি প্রাপ্ত ভাইরাসের আরএনএ-র নমুনা ‘থেকে বলা যাচ্ছে না যে তাতে সক্রিয় ভাইরাস আছে এবং তা সংক্রমণ ঘটাতে পারে।’’ সেই বিবৃতিতে চিনে তাঁদের নিজেদের তরফে ৭৫০০০ কোভিড-১৯ রোগীর ওপর চালানো সমীক্ষার কথাও আছে, বলা হয়েছে ওতে তাঁরা বায়ুবাহিত সংক্রমণের কোনও প্রমাণ পাননি। বেন কাউলিং বলছেন, ‘‘(হু-র দেওয়া) এই অ্যাসেসমেন্টের স্বপক্ষে দাঁড় করানোর মতো তেমন যথেষ্ট প্রমাণ কিন্তু এতে নেই’’, এবং প্রমাণ মিলছে না বলে এও ধরে নেওয়া যায় না যে সার্স-কভ-টু বায়ুবাহিত নয়। এই অপ্রতুল প্রমাণের যাথার্থ্য সম্পর্কে নেচার-এর তোলা প্রশ্নের কোনও উত্তরহু পাঠায়নি অন্তত এই লেখা প্রকাশিত হবার আগে অবধি।

আমেরিকার বিজ্ঞানীরা দেখেছেন এই ভাইরাসটা এরোসলে ভাসমান থাকতে পারে এবং তার সংক্রামক চরিত্রও বজায় রাখতে পারে কম করে ৩ ঘণ্টা পর্যন্ত। যে-পরিবেশেওই পরীক্ষা করা হয়েছিল সেটা অবশ্য ‘অতিমাত্রায় কৃত্রিম’। কিন্তু তা সত্ত্বেও ‘বাতাস মারফত দূরপাল্লার সংক্রমণ সম্ভাবনা একেবারে শূন্য নয়’’, বলেছেন লস এঞ্জেলেস-এ ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার সংক্রামক ব্যাধি গবেষক জেমি লয়েড-স্মিথ। তিনি এই গবেষণার অন্যতম সহকারী।

সার্স-কভ-টু-কে বায়ুবাহিত বলে মেনে নেওয়ার পক্ষে পর্যাপ্ত প্রমাণ আছে বলে মনে করেন না লিও পুন, হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজিস্ট। এমন কিছু পরীক্ষা করা দরকার বলে তিনি মনে করেন যার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হবে এইসব বিভিন্ন মাপের অণুবিন্দুতে থাকা ভাইরাস সত্যিই রোগ ঘটায়।

কোভিড-১৯ আক্রান্ত মানুষের নাক-মুখ থেকে শঙ্কিত হবার মতো মাত্রায় ভাইরাস-পৃক্ত এরোসল বেরয় কি না সেটাও একটা প্রশ্ন, বলছেন লয়েড-স্মিথ। তিনি বলছেন, এই মানুষেরা যখন কথা বলছে, শ্বাস ছাড়ছে, হাঁচি বা কাশি হচ্ছে তাঁদের, তখন বাতাসের নমুনা নেওয়া দরকার, এবং পরীক্ষা করে দেখা দরকার তাতে সত্যিই সংক্রমণ-ক্ষম ভাইরাস আছে কিনা। আর এসব কাজই ‘‘এই ধাঁধাটার আর-একটা বড় অংশ।’’ এরকম একটা পরীক্ষায় কোভিড-১৯ আক্রান্ত এক রোগী - যিনি কথা বলছেন, নিশ্বাস ছাড়ছেন, কাশছেন, তাঁর ১০ সেন্টিমিটার দূর থেকে বাতাসের নমুনা নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছিল। সেই পরীক্ষা থেকে ভাইরাসের আরএনএ-র অস্তিত্ব মেলেনি বটে, কিন্তু গবেষকরা বায়ুবাহিত ভাইরাস সংবহনের সম্ভাবনাকে একেবারে খারিজ করেও দেননি।

আর একটা জরুরি খুঁটিনাটি যেটা এখনও অজানা তা হল, ‘ইনফেকশাস ডোজ’ - কী মাত্রায় ভাইরাস থাকলে তা থেকে সংক্রমণ ঘটতে পারে, বলছেন লয়েড-স্মিথ। অর্থাৎ রোগ ঘটানোর জন্য কতগুলো সার্স-কোভ-টু কণা লাগে? ‘‘নিশ্বাসের সঙ্গে যে এরোসল-রূপী ভাইরাস বেরয় তার ইনফেকশাস ডোজ কত, কী মাত্রায় এলে সংক্রমিত হওয়ার পর্যাপ্ত সম্ভাবনা থাকে সেটা আমরা এখনও জানি না।’’ মাত্রাটা কী তা জানার জন্য পরীক্ষা সাজানোর একটা দায় আছে, জেনেবুঝে মানুষকে নানা মাত্রার আবহে রেখে প্রতি ক্ষেত্রে সংক্রমণের হার বের করা - এটা একটা অনৈতিক কাজ। বিশেষ করে আমরা যেখানে এ রোগের করাল চরিত্রটা জানি।

ট্যাং একটা ভিন্ন প্রসঙ্গ তুলেছেন। তিনি বলছেন, সংক্রমণ ঘটানোর জন্য পর্যাপ্ত মাত্রাটা যাই হোক না কেন, আর একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, কতক্ষণ ধরে একজন সেই পরিবেশে থাকছে। একবারের নিশ্বাসে হয়তো তেমন ভাইরাস বেরয় না, কিন্তু ‘‘তুমি যদি (আক্রান্ত কোনও ব্যক্তির) পাশে থাকো, একই বাতাসে শ্বাস নাও ৪৫ মিনিট ধরে, তাহলে সংক্রমিত হওয়ার মতো পর্যাপ্ত ভাইরাস তোমার মধ্যে ঢুকবে।’’

কিন্তু ক্রমান্বয়ে জমে জমে সংক্রমণ ঘটানোর মাত্রায় পৌঁছতে পারে এমন সামান্য পরিমাণ এরোসল সংগ্রহ করা – আর সেটাও সঠিক বায়ুপ্রবাহ, আর্দ্রতা আর তাপমাত্রার মিশেল মেনে, ‘এক চরম কঠিন কাজ’, বলেছেন মোরাওস্কা। ‘‘আরও ডেটা দরকার সেটা তো বলাই যায়, কিন্তু সেটা জোগাড় করা যে খুব কঠিন তাও স্বীকার করতে হবে।’’ট্যাং বলছেন, বাতাস বেয়ে এই সংক্রমণ ছড়ায় সেটাই ধরে এগোনোই ভালো – যদি না পরীক্ষায় সেটাকে ভুল প্রমাণ করা যায়। কিন্তু উল্টোটা ধরে এগোনো ঠিক হবে না। মানুষ তাহলেই সাবধান থাকতে পারবে, নিজেকে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করবে।

মোরাওস্কা বলছেন, ঘরের ভেতরকার বায়ু চলাচল বাড়ানো দরকার আর একই বাতাস ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করাটা কমানো দরকার। তাহলেই ভেতরকার বাতাসে এরোসলের ঘনত্ব কিছু কমানো সম্ভব, ঝেঁটিয়ে বের করে দেওয়া সম্ভব। সাবধানের মার নেই, কাজেই ঘরে বসে মিটিং করা বন্ধ রাখাই শ্রেয়।

ইতিমধ্যে ল্যান এবং তাঁর সতীর্থরা জনসাধারণকে মুখোশ পরে থাকতে বলছেন, তার মধ্য দিয়ে সংক্রমণের মাত্রা নামানো যাবে বলেই তাঁদের অভিমত। এশিয়ার বহু দেশেই মুখোশ একটা আটপৌরে উপকরণ। আমেরিকায় এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশে অবশ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকরা সাধারণ মানুষকে মুখোশ পরা থেকে নিবৃ্ত রাখতে চায়। তার একটা কারণ হল, এই উপকরণটির সরবরাহ কম এবং স্বাস্থ্যকর্মীদেরই সেটা আগে দরকার। চেক রিপাবলিক এবং স্লোভাকিয়া অবশ্য বাড়ির বাইরে বেরলেই সকলের মুখোশ পরা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। ট্যাং মনে করেন, এরা ঠিক কাজই করেছে। ‘‘ওরা সাউথ-ইস্ট এশিয়ার ধারাটা নিয়েছে, যদি প্রত্যেকে মুখোশ পরে তাহলে এটা দোফলা অর্থাৎ দ্বিগুণ সুরক্ষা দেবে।’’

অবশ্য, কাউলিং-এর মতে, স্বাস্থ্যকর্মী, রোগের লক্ষণ দেখা দিচ্ছে এমনমানুষ এবং সহজে আক্রান্ত হতে পারে এমন জলগোষ্ঠীর জন্য মুখোশের পর্যাপ্ত সরবরাহ সুনিশ্চিত করার পরেই কেবল সকলকে তা পরতে বলা উচিত।

[অনুবাদ: যুধাজিৎ দাশগুপ্ত]

Is the coronavirus airborne? Experts can’t agree শিরোনামে Dyani Lewis-এর এই লেখাটি বেরিয়েছিল নেচার পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে, ২ এপ্রিল ২০২০ (doi: 10.1038/d41586-020-00974-w)

নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে ভাইরাস!

আমেরিকার ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স (এন.এ.এস.) একটা অস্বস্তিকর ভাবনা উসকে দিল। এঁরা বলছেন, কেবল হাঁচি-কাশির সঙ্গে ছিটকে বেরনো অণুবৎ বিন্দু থেকে নয়, নয়া করোনাভাইরাস বাতাসে ভর করেও ছড়াতে পারে। যতটুকু গবেষণা হয়েছে তা থেকে নিশ্চিত কোনও বার্তা মিলছে না, কিন্তু হার্ভে ফাইনবার্গ লিখছেন, ‘‘যেসব পরীক্ষার ফলাফল হাতে এসেছে তাতে মনে হচ্ছে স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে ভাইরাস যে এরোসলে রূপান্তরিত হয়েও সংক্রমিত হতে পারে তার সমর্থন মিলেছে।’’ এরোসল হল এমন ক্ষুদ্র কণা যা বাতাসে দীর্ঘক্ষণ ভেসে থাকতে পারে। হার্ভে ফাইনবার্গ হলেন ‘ইমার্জিং ইনফেকশাস ডিজিজ অ্যান্ড টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি হেলথ থ্রেটস’ নামে এক কমিটির প্রধান। ওপরের বার্তাটি তিনি পাঠিয়েছেন হোয়াইট হাউস অফিস অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি পলিসি-র প্রধান কেলভিন ড্রোজেমেয়ারকে।

এতদিন অবধি আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সি.ডি.সি) এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যতত্ত্বাবধায়ক সংস্থাগুলো বলে আসছিল যে, সার্স-কভ-টু-র সংক্রমণের প্রাথমিক মাধ্যম হল অপেক্ষাকৃত বড় মাপের, ধরা যাক প্রায় ১ মিলিমিটার মাপের, অণুবৎ বিন্দু যা নাক-মুখ থেকে হাঁচি-কাশির সঙ্গে বেরিয়ে আসে। মাধ্যাকর্ষণের টানে এই বিন্দুগুলো দু-এক মিটার দূরত্ব পেরনোর আগেই মাটিতে পড়ে যায়। এ-ও ঠিক যে, যার ওপর বিন্দুগুলো পড়ে সেখান থেকে অন্য কারও হাতে লেগে যেতে পারে এবং নাকে মুখে বা চোখে হাত দেওয়ার মাধ্যমে সেসবের দ্বারাও সে মানুষটি আক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু যদি সত্যিই ধরা পড়ে যে, করোনাভাইরাস নিশ্বাসের সঙ্গে অতি হালকা যে-বাষ্প বেরয় তার ভেতরেও ভেসে থাকতে পারে, তবে মানতেই হবে অন্যদের পক্ষে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা বেশ দুরূহ কাজ। এটা সত্যি হলে জনসমক্ষে আসা প্রত্যেকে মানুষেরই মুখ-ঢাকা মুখোশ পরার পক্ষে যে-দাবিটা উঠেছে, সেটাও তখন জোর পেয়ে যাবে। যার দেহে রোগের লক্ষণ তখনও ফোটেনি অথচ যে এই ভাইরাসের বাহক, অজান্তে তার দ্বারা সংক্রমিত হওয়া ঠেকানোর জন্য এই মুখোশ ধারণ জরুরি হয়ে উঠবে।

বিতর্কের শুরু যখন নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন এই বছরের গোড়ায় একটা গবেষণার ফলাফল বের করে। সেই গবেষণা বলছে, সার্স-কভ-টু এরোসল বিন্দু হয়ে ভেসে থাকতে পারে। ৫ মাইক্রনেরও ছোট এই বিন্দুগুলো বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারে প্রায় ৩ ঘন্টা অবধি, এবং তাদের সংক্রামক চরিত্রও বজায় থাকে।

আরও একটি পরীক্ষার উল্লেখ করেছেন ফাইনবার্গ এবং এন এ এস-এর সতীর্থরা। তার একটা হল ইউনিভার্সিটি অফ নেব্রাস্কা মেডিক্যাল সেন্টারের জোশুয়া সান্তারপিয়া এবং তাঁর সতীর্থদের কাজ। তাঁরা দেখেছেন, কোভিড-১৯ রুগীদের আলাদা করে রাখা এক ঘরের বাতাসে ভাইরাসের আরএনএ রয়েছে। রোগীদের থেকে দুই মিটারেরও বেশি দূরত্বের বাতাসে ভাইরাস আরএনএ পাওয়া গেছে, এমনকী সেটা মিলেছে ঘরের যেসব কোনায় সহজে কারও নাগাল পৌঁছয় না সেখান থেকেও। তাঁরা বলছেন, আরএনএ থাকার অর্থই হল, ভাইরাসটা এরোসল বেয়েও ছড়াতে পারে। যদিও সরাসরি সংক্রামক কোনও ভাইরাস-কণা তাঁরা সেখানে পাননি।

আর-একটা গবেষণা-ফলাফলের প্রাক-প্রকাশ সংস্করণ থেকে এন.এ.এস.-এর প্রতিবেদক গোষ্ঠী কিছু আশঙ্কার সূত্র খুঁজে পেয়েছেন। তাঁরা দেখেছেন, স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণগুলো (পারসোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট, পি.পি.ই.) থেকেও সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের য়ুয়ান লিউ পরিচালিত এই গবেষকদল জানাচ্ছেন, স্বাস্থ্যকর্মীরা যখন তাঁদের পি.পি.ই. খুলে রাখেন, মেঝে পরিষ্কার করেন বা সংক্রমিত এলাকার মধ্য দিয়ে যান তখন তাদের শরীর থেকে বাতাসে সংক্রামক ভাইরাস ফিরে ঢোকার সম্ভাবনা রয়ে যায়। এন.এ.এস. প্রতিবেদকদের মতে, সব কিছু মিলিয়ে ভাবলে, ‘‘হাঁচিকাশি থেকে বাতাসে ঠিকরে আসা অণুবৎ বিন্দু এবং এরোসল, উভয়ের ভেতরেই ভাইরাস-আরএনএ খুঁজে পাওয়ার অর্থ হল, এই পথেও ভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে।’’

‘এরোসলাইজেশনের মতবাদটা যে গৃহীত হচ্ছে এটাই আমার কাছে একটা বড় স্বস্তি।’ বলেছেন কিম্বারলি প্রাথের, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সান দিয়েগো-র এক রসায়নবিদ। সায়েন্সইনসাইডার-কে পাঠানো একটা ই-মেলে তিনি বলেছেন, ‘এই বায়ুবাহী মাধ্যমটাকে হিসেবে ধরার ফলে বুঝতে সুবিধে হবে যে কেন এই সংক্রমণটা এত দ্রুত ছড়াচ্ছে।’’

মুখোশ পরার যুক্তিটাও জোর পাচ্ছে এর দ্বারা। এন.এ.এস. প্রতিবেদক গোষ্ঠী, হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যান্সি লিউং এবং তাঁর সতীর্থদের লেখা একটা গবেষণাপত্রের উল্লেখ করেছেন। ভাইরাসের সংক্রমণে শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হওয়া বেশ কিছু রোগীর হাঁচি-কাশি থেকে ছিটকে আসা অণুবৎ বিন্দু আর এই রোগীরা যে যেখানে আছেন তার বাতাসে ভাসমান পদার্থ এই গবেষকরা সংগ্রহ করেছিলেন। রোগীদের মধ্যে কয়েকজন সার্জিক্যাল মুখোশ পরেছিলেন। মুখোশ পরা থাকলে বাতাসে ভাসমান এরোসল এবং শ্বাসাঘাত-সৃষ্ট অণুবিন্দু দুটোতেই করোনাভাইরাসের আরএনএ কম পাওয়া গেছে। কিন্তু কেবল ইনফ্লুয়েঞ্জায় ভোগা মানুষদের হাঁচিকাশি নিঃসৃত অণুবিন্দুতেই এটা কম পাওয়া গেছে। গবেষকরা বলছেন, যাদের মধ্যে সংক্রমণের লক্ষণ ধরা পড়েছে তারা সার্জিক্যাল মুখোশ পরলে যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ আটকানো যেতে পারে তার স্বপক্ষে একটা কার্যকারণ-মানা প্রমাণ জোগাচ্ছে আমাদের পরীক্ষার ফলাফল।

এরোসল থেকে সংক্রমণ ছড়াতে পারে এটা অবশ্য বিশেষজ্ঞদের প্রত্যেকে মানতে নারাজ। ২৭ মার্চ হু (ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশন) একটা প্রতিবেদনে জানায়, কোনও কোনও বিশেষ অবস্থায় এরোসলের মাধ্যমে সংক্রমণ হয়তো বা সম্ভব, যেমন স্বাস্থ্যকর্মীরা যখন কোনও মারাত্মক অসুস্থ রোগীকে শ্বাস-নল পরাচ্ছেন। কিন্তু, হু-বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, চিনের ৭৫০০০-এরও বেশি করোনাভাইরাস আক্রান্তের উদাহরণ থেকে বলা যেতে পারে, কোনও ক্ষেত্রেই বাতাসবাহী সংক্রমণের কোনও প্রমাণ নেই। বিজ্ঞানী সানন্তারপিয়া প্রমুখের গবেষণা প্রসঙ্গে এই বিশেষজ্ঞদের মত হল, পিসিআর যন্ত্র মারফত বাতাসের নমুনা বিশ্লেষণ করে ভাইরাসের আরএনএ খুঁজে পাওয়ার অর্থ এই নয় যে, তাতে সংক্রমণ ঘটানোর যোগ্য ভাইরাস আছে।

তবে, এই বিতর্কের পর সি.ডি.সি. আপাতদৃষ্টিতে তাদের অবস্থানটাকে একটু ঝালিয়ে নিতে চলেছে। বেশ কয়েকটা সংবাদে প্রকাশ পেয়েছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আটকানোর জন্য এই সংস্থা আমেরিকার প্রত্যেককে জনসমক্ষে বেরনোর সময় মুখোশ পরার সুপারিশ করতে চলেছে।

[অনুবাদ: যুধাজিৎ দাশগুপ্ত]

২ এপ্রিল ২০২০ এই প্রতিবেদনটা You may be able to spreadcoronavirus just by breathing, new report finds শিরোনামে অনলাইন প্রকাশিত হয়েছে সায়েন্সম্যাগ-এ। সায়েন্সম্যাগের প্রকাশক ‘আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি অ্যাডভান্সমেন্ট অফ সায়েন্স’।