যুধাজিৎ দাশগুপ্ত

গাছ জানে

কোস্ট স্যালিশ মানুষেরা বলে, ‘আমরা সকলে এক’। হাজার হাজার বছর ধরে তারা সেই মন্ত্র মেনেই জীবন কাটিয়েছে। কিন্তু আমরা সেদিকে নজর দিইনি। আমরা প্রায় সকলেই ভুলতে বসেছি যে আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের সঙ্গে জুড়ে আছি। জুড়ে আছি প্রকৃতির সঙ্গে। আমরা প্রত্যেকে একটিই সত্তা। তা বলে প্রকৃতিও আলাদা কিছু নয়, আমরা তারই অঙ্গ। পৃথিবীতে আমরা যা কিছু করি, তার ঢেউ ছড়ায় গোটা ইকোসিস্টেমে, আমাদের প্রত্যেককে জুড়ে থাকা জালিকাবিন্যাসের মধ্যে। এর লক্ষণগুলোও তো এখন আর কিছুতে অস্বীকার করা যাচ্ছে না! জলবায়ু বিপাক, প্রজাতির বিলোপ, মানুষের দুর্দশা – এ সবই সেদিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করছে। আমরা তা ভুলেছি।

কোস্ট স্যালিশ (Coast Salish*) মানুষেরা বিশ্বাস করে, সমস্ত মানুষ অরণ্যের আত্মার সঙ্গে, সমুদ্র ও নদীর আত্মার সঙ্গে, ভাল্লুক ও স্যামন মাছের আত্মার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জোড়া। আমরা তাদের সে-বিশ্বাসকে অগ্রাহ্য করি।

সত্যিই, জটিল এই প্রকৃতির সংগঠনের মূলে রয়েছে যে আন্তঃসম্পর্ক তাতে ভরসা রাখা, তাকে শ্রদ্ধা করা, এ শেষ অবধি একপ্রকার বিশ্বাস বই আর কী! আমরা তাকে অবৈজ্ঞানিক বলি। পশ্চিমি বিজ্ঞান দাবি করে নিখুঁত পরিমাপ, চোখে আঙুল দেওয়া প্রমাণ, পরিসংখ্যান। ভুলে যাবেন না, কোস্ট স্যালিশ মানুষেরা কম বৈজ্ঞানিক নয়। তা না হলে তারা কী করে এখানে বেঁচে আছে গত দশ হাজার ধরে, তাও এমন সমৃদ্ধির সঙ্গে?

সত্যি বলতে কী, তারা আমাদের থেকেও বেশি বিজ্ঞানভাবাপন্ন। আমরা যদি আরও গভীরভাবে ভাবতে বসতে পারতাম তো আমাদের তথাকথিত উন্নয়নের চাকা বসে যেত। ওই অরণ্যগুলোতে আছে বৃক্ষ, আমাদের বাড়ি বানাতে লাগবে কাঠ। আমাদের প্রিন্টারগুলোকে খাওয়াতে হবে কাগজ।

কথা হচ্ছে, এসবের ভেতর আমি এলাম কী করে?

তবে বলি, আমার পরিবারের পেশা ছিল গাছ-কাটা। আমার বাড়ির লোকেরা যখন পাহাড়ের ঢালের ওপর দিকে গাছে কাটছে, এখানে একটা, ওখানে একটা, সেখানে একটা - আমি তখন নীচের জঙ্গলে খেলে বেড়াচ্ছি। দেখা-অদেখা নানাখানে। গাছের ফাঁকেফোকরে, কাটা গুঁড়িগুলোর ভেতর দিয়ে, জঙ্গলের জমিতে।

আমার বিশ্বাস ছিল, পরীরা বাস করে ওখানে। তারা ওখানে বাস করে, আর জঙ্গলটাকে রক্ষা করে, ঠিক যেমনটা কিনা আমার কাজ বলে আমি ভাবতাম। কিন্তু পরীরা পারেনি জঙ্গলটাকে বাঁচাতে। আমিও না। সত্যি বলতে কী, পারেনি কেউই।

পারেনি, কারণ এ অরণ্যের যিনি মালিক তাঁকে গাছগুলো কেটে ফেলতে হচ্ছিল তাঁর পরিবারের মুখে আহার তুলে দেবার জন্যই। কিন্তু সেইসব মুহূর্তই আমাকে বদলে দিল সারাজীবনের নামে। সত্যি বলতে কী, আমাকে দিল প্রেরণা। আমি ফরেস্ট্রি নিয়ে পড়তে ঢুকলাম। আমি বুঝতে চাইলাম, কী সে রহস্য যার জন্য অরণ্যকে আমার এত প্রবল শক্তিধর বলে মনে হয়! আমি জঙ্গল বাঁচাতে চাইছিলাম।

ভাগ্যের পরিহাস বলে ঠেকবে হয়তো, কারণ ফরেস্ট্রি পাঠ সাঙ্গ করে বেরনোর পর প্রথম যে চাকরি পেলাম তার কাজ ছিল অরণ্যের প্রাচীন অংশগুলোকে চিহ্নিত করা, যাতে সেগুলো একলপ্তে কেটে বন সাফ করে ফেলা যায়। তার পর সেখানেই ফার আর পাইন গাছের চারা লাগানো হবে, কেননা সেগুলোর বাড় খুব দ্রুত। সেইসঙ্গে অবাঞ্ছিত গাছ, যেমন অ্যাল্ডার, বার্চ, অ্যাস্পেন, এগুলোকে নির্মূল করে হঠিয়ে দেওয়া হবে। কেন হঠানো হবে? কারণ আমরা মনে করতাম ওগুলোর জন্য আমাদের লাভ কমে যাচ্ছে, গাছগুলো আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী।

তো, ঝকঝকে সার-সার একই প্রজাতির গাছের নতুন বন, যাকে মোনোকালচার বলি, তা বসানোর কাজে আমি বেশ দড় হয়ে উঠলাম। কিন্তু প্রশ্নের পর প্রশ্ন জমতে থাকল।

কেন এই গাছগুলোতে এত রোগ ছড়াচ্ছে?

বার্চ কাটলে কেন ফার গাছগুলো রুগ্‌ণ হয়ে পড়ছে?

হ্যাঁ, আরও ছিল – প্রাচীন অরণ্য কেটে সাফ করার হার এত বাড়ছিল সেটাতেই আমি শঙ্কিত হয়ে পড়ছিলাম। আমি ফরেস্ট্রি স্কুলেই পড়েছিলাম যে প্রায় এক শতাব্দি আগে থেকে কানাডায়, ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায়, সমস্ত আদিম অরণ্য কেটে সাফ করার পরিকল্পনা তৈরি হয়েছিল। এ আমি জানতাম, স্কুলেই পড়েছি। তবু এটা বুঝতে আমার অনেকদিন লেগে গেল যে, এই বৃক্ষচ্ছেদন বন্ধ হবার নয়। এই ভাবনাতেও ছেদ পড়ার নয় যে, আদিম এই অরণ্য কেটে ফেলে সেখানে ছিমছাম বিপণনযোগ্য গাছ লাগানোই শ্রেয় কাজ।

অথচ আমার কেবলই মনে হচ্ছিল অরণ্যের যেটুকু চোখে পড়ে তার বাইরেও রয়ে গেছে আরও অনেক রহস্য। আমি তাই গ্র্যাজুয়েট ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে কাজ শুরু করলাম, মাটির নীচে কী আছে তা জানবার আগ্রহ আমাকে পেয়ে বসল। আমি বুঝতে চাইলাম কেন আদিম অরণ্যগুলো এত বলিষ্ঠ।

2020-02-02--17-

আমার নজরে এল যুক্তরাজ্যে করা একটা গবেষণা, সেখানে তারা গবেষণাগারে চারাগাছ বড় করে তোলার সময় একধরনের ছত্রাকের সন্নিবেশ ঘটিয়েছিল। সেগুলো ছিল মাইকোরাইজাল ফাংগাস (Micorrhizal Fungus)। এই ছত্রাকগুলো চারাগাছের শেকড়গুলোকে ঘিরে একটা পরস্পরসংযুক্ত জাল তৈরি করেছিল, আর সেই জাল একটা চারাগাছ থেকে অপর চারাগাছে পৌঁছে দিচ্ছিল কার্বন।

মাইকোরাইজাকে বলা যেতে পারে ছত্রাক-শেকড়, এর আক্ষরিক অর্থটাই তাই। গাছের সঙ্গে তাদের তৈরি হয়েছে এক মিথোজীবী সম্পর্ক, এগুলো মাটিতে বেড়ে চলে, মাটি থেকে জল আর জরুরি উপাদান সংগ্রহ করে সেগুলো গাছকে পৌঁছে দেয়, তার বদলে পায় সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় সংগৃহীত কার্বন। এটাকে বলতে পারি সিমবায়োটিক, মিউচুয়ালিস্টিক, রেসিপ্রোকাল সম্পর্ক।

আরও যা বিস্ময়কর ঠেকল আমার কাছে সেটা হল, ছত্রাকগুলো মাটির তলা দিয়ে পরস্পর গাছগুলোকে জুড়ে দিতে পারে। আমার মাথায় ভাবনা ঢুকল, এমনও কি হতে পারে যে, বার্চের জঙ্গলে ছড়িয়ে থাকা ছত্রাকগুলো ফার গাছের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ঘটায়, আর তার ফলে ফার গাছগুলো রক্ষা পায়? এটা আমাকে খুঁজে দেখতে হবে।

আমি তাই কয়েকটা পরীক্ষা সাজালাম। আমার প্রথম প্রশ্নটা ঘুরে সেই বিশ্বাসের দরজাতেই এল। আমাদের চোখে পড়ে না যদিও, তবু এমন কি হতে পারে যে, এই মাইকোরাইজাল ছত্রাকগুলো মাটির তলা দিয়ে গাছের সঙ্গে গাছকে জুড়ে দিচ্ছে?

Plants2

যেটা ধরা পড়ল তা হল, হ্যাঁ, প্রকৃত অরণ্যে সেটাই ঘটছে। ডিএনএ মাইক্রোস্যাটেলাইট কাজে লাগিয়ে আমরা ডগলাস ফারের এক আদিম অরণ্যে সেটাই আবিষ্কার করলাম। এই ছবিতে বৃত্তগুলো এক একটা ডগলাস ফার বোঝাচ্ছে। বৃত্তটা যত বড় আর তার রং যত ঘন, গাছটা তত বড় আর তত প্রাচীন। মাঝামাঝি যে ছোট ছোট হালকা রঙের বৃত্তগুলো আছে সেগুলো জঙ্গলের নীচের থাকে বেড়ে উঠতে থাকা চারাগাছ।

আর ওই বৃত্তগুলোকে পরস্পর জুড়েছে যে-রেখাগুলো সেগুলো হল পরস্পরসংযোগকারী মাইকোরাইজাল ছত্রাকে গড়া প্রবাহপথ, হাইওয়ে। খেয়াল করে দেখুন, সবথেকে বড়, সবথেকে গাঢ় রঙের বৃত্তগুলোর সঙ্গেই অন্যান্য বৃত্তের সংযোগ ঘটেছে সবথেকে বেশি। আমরা এগুলোকে বলি ‘হাব ট্রিজ’ (Hub Trees), কেন্দ্রীয় গাছ। পরে ভালবেসে এগুলোকে ডাকতে থাকি ‘মাদার ট্রি’ বলে, কেননা এটাও ধরা পড়ে যে এই জননী বৃক্ষগুলোই জঙ্গলের নীচের থাকে বেড়ে উঠতে থাকা নবীন চারাগাছগুলোর পরিচর্যা করে।

ছবিতে যেটা দেখছেন তা মাত্র দু’ধরনের ছত্রাক কাজে লাগিয়ে তৈরি একটা ম্যাপ, ওরকম প্রায় একশো ছত্রাক কোনও জঙ্গলে আছে বলে আমরা মনে করি। ভাবতে পারছেন ওই একশো রকম ছত্রাকের সংযোগরেখাগুলো ম্যাপে আঁকতে পারলে কেমন দাঁড়াত!

এর পর আমার জিজ্ঞাসাটা দাঁড়াল, এই সংযোগবিন্যাসের মধ্য দিয়ে যা প্রবাহিত হচ্ছে সেটা কী?

Plants1

দেখা গেল সেটা আর কিছু নয়, একটা গাছের বেঁচে থাকার জন্য, বেড়ে ওঠার জন্য যা-যা দরকার, সেইসব। কার্বন, বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান আর জল। আমরা এই কাজে ব্যবহার করেছিলাম আইসোটোপ। কার্বন আইসোটোপ। তা দিয়ে গাছগুলোকে চিহ্নিত করলাম এবং দেখলাম কার্বন কীভাবে এই নেটওয়ার্কের মধ্য দিয়ে যাওয়া-আসা করছে – ঠিক যেন ইন্টারনেটের মধ্য দিয়ে বার্তার যাওয়া-আসা। যখনই কোনও চারাগাছ কষ্টে থাকে, হয়তো সে খুবই ছোট, অথবা এর ওপর সূর্যালোক পড়ে না, কিংবা পুষ্টি উপাদান জোটে না যথেষ্ট, কিংবা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝামড়ে যাচ্ছে – তখনই অন্য গাছগুলো তাকে পাঠায় কার্বন। আমরা বার করতে পেরেছি যে, এখানে উৎস গাছ থেকে উদ্দিষ্ট গাছ বরাবর পুষ্টি-উপাদানের একটা ক্রমিক তর-তম আছে, যাকে আমরা বলি ‘সোর্স-সিংক গ্রেডিয়েন্ট’। তার অভিমুখটা ধরা যাক, যথেষ্ট আলোকিত তাগড়া কোনও বার্চ গাছ থেকে অরণ্যের নীচের থাকের বাসিন্দা কোনও অভাবি ফার গাছের দিকে। আর এ সমস্ত যে ঘটছে তাতে উৎস গাছটার কোনও ক্ষতিও হচ্ছে না।

আমাদের পরবর্তী জিজ্ঞাসাটা হল, বেশ, জানা গেল এরকমটাই ঘটে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এতে অরণ্যের কী? দেখা গেল, একটা গাছ যদি ছায়ায় ঢাকা থাকে, ধরা যাক ডগলাস ফার যদি ছায়াচ্ছন্ন হয়, তবে বার্চ তার নিজের কার্বনের এক-দশমাংশ তাকে পাঠায়। সেটা কিন্তু অনেক কার্বন। তা কাজে লাগিয়ে ডগলাস ফার অবশ্যই তার বীজ তৈরি করে ফেলতে পারবে।

ঘটনা হল, এই পরিমাণটা ঠিক কী বোঝায় তা আমরা তেমন ভালভাবে বের করতে পারিনি, কিন্তু এটা জানি যে এভাবে উপাদান সরবরাহের ফলে গাছগুলোর বৃদ্ধির হার বাড়ে, বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা বাড়ে। অরণ্যের একেবারে নীচের তলাকার চারাগাছগুলোর স্বাস্থ্য ভাল হয়।

আমি কয়েকটা উঁচুমানের জার্নালে আমার কাজ নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছিলাম। তার মধ্যে একটা লেখা খুব সাড়া জাগিয়েছিল। প্রচুর মানুষ এ থেকে উৎসাহ পাচ্ছিলেন। সত্যি বলতে কী, এই গবেষণাপত্র থেকে প্রেরণা নিয়ে পৃথিবী জুড়ে এই বিষয়ে নতুন নতুন গবেষণার সূত্রপাত হচ্ছিল।

Plants5

তবে বিরুদ্ধ সমালোচকরাও ছিলেন, তাঁরা আমার কাজকে পাত্তা দিতে চাননি। সমালোচনা করে অনেক প্রবন্ধ লেখা হচ্ছিল, অনেক বক্তৃতাসভার প্রারম্ভিক কথনে উত্থাপিত হচ্ছিল এর বিরুদ্ধ মত, পত্রপত্রিকায় বিবৃতি পাঠানো হচ্ছিল। আমার নিজের প্রতিষ্ঠানের কথা যদি ধরি তো বলতে হয় তারা আমার ফাইলে গুঁজে দিল প্রফেশনাল এথিকস সংক্রান্ত চেতাবনি। আমার কাজ নাকি নিতান্ত এলোমেলো অগোছালো বেখাপ্পা – এদেশে যাকে ব্যঙ্গ করে বলে ‘ডগস ব্রেকফাস্ট’।

আমি জানি এটা আপনাদের কাছেও অজানা নেই যে, যখনই কোনও নতুন দিশার সন্ধান দেয় কোনও গবেষণা, যখন তা চলতি স্থিতাবস্থাটাকে ভেঙে ফেলতে চায়, তখনই এ ধরনের ভয়-দেখানো ব্যাপার চলতে থাকে। এটা যখন বুঝতে পেরেছি তখন আর থামা নেই। আমার সায়েন্সটা যে নিশ্ছিদ্র, কাজটা রীতিমতো খুঁটিয়ে করা, সেটা তো আমি জানি। আমি এ-ও জানি যে একদিন এই কাজটা পরিবেশ নিয়ে আমাদের ভাবনাটাকে পুরো বদলে দেবে।

কাজেই, রীতিমতো উজ্জীবিত হয়ে আমি আমার গোড়ার প্রশ্নে ফিরে গেলাম, কারণ তখনও তার উত্তর ঠিকভাবে আমার হাতে আসেনি। একটা ভাবনা আমাকে খোঁচাতে থাকল যে এইসব পারস্পরিক সংযোগ, এই যে সম্পর্কের আন্তর্জাল, এ কি কেবলই পুষ্টি উপাদান, কার্বন আর জল আদানপ্রদানের রাস্তা? যে-গাছটা পীড়িত, যার রোগ হয়েছে, তাকে কি সত্যি সত্যি তার প্রতিবেশী স্বাস্থ্যবান গাছগুলো কোনও উপকার জোগাতে পারে? বার্চ কি ফার-এর সহায়?

কাজেই আমি আরও কিছু পরীক্ষা করলাম, এবং দেখলাম, হ্যাঁ ঠিক তাই। ডগলাস ফার যখনই পীড়া বোধ করে, যখনই তার রোগ হয়, সে তার প্রতিবেশী গাছেদের কাছে সতর্কবার্তা পাঠাতে থাকে। আর প্রতিবেশীরা তাতে সাড়া দেয় আরও বেশি বেশি করে প্রতিষেধক এনজাইম বানিয়ে। এর সুবাদেই প্রতিবেশী গাছগুলো নিজেরা রোগপ্রতিরোধী হয়ে ওঠে। যদি এই প্রতিবেশীদের একটি গাছ হয় কোনও বার্চ, তবে ফার গাছটির কাছেও সাহায্য এসে পৌঁছয় ওই পারস্পরিক সংযোগজালের সঙ্গে জড়িত অ্যান্টিবোয়োটিক উৎপাদনক্ষম ব্যাকটিরিয়া মারফত। ব্যাপারটা অনেকটা আমজনতাকে টিকা দেওয়ার মতো।

আমি ভাবতে বসলাম, প্রতিরোধক বিপদবার্তার চলাচল ছাড়া আরও কিছু কি আছে আর মধ্যে? কী দেখলাম? দেখলাম গাছেরা তাদের নিজেদের আত্মীয়দের চিনে নিতে পারে, তাদের সঙ্গে বার্তা বিনিময় করতে পারে। কোনও জননী গাছ ঠিকই চিনতে পারে আশপাশের চারাগাছগুলো তার নিজের সন্তান, নাকি অপরিচিত কেউ। অপরিচিত চারাগাছকে সে যত কার্বন পাঠায় তার থেকেও বেশি পাঠায় নিজের আত্মীয় চারাগাছগুলোকে। জননী গাছ যদি কখনও আহত হয় সে তার আত্মীয় চারাগাছগুলোকে আরও বেশি বেশি কার্বন পাঠাতে থাকে। যেন সে তার শক্তি, তার যা কিছু অর্জন সে যেন তার পরের প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে।

আমি যতই এই সমস্ত বিষয়গুলো একসঙ্গে ভাবতে বসি, আমার মনে হতে থাকে এইসব গাছ যেন তাদের জীবনের গভীর রহস্যের কথা আমাদের বলে যাচ্ছে। এটা একেবারে আনকোরা একটা ভাবনা। খুবই উত্তেজনা জাগায়। একটা সময়ে এ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছিল, বিষয়টা আসছিল পপুলার সায়েন্স হিসেবে, ডকুমেন্টারি ফিল্মে, বার্তাটা ক্রমশ যত ছড়িয়ে পড়ছিল, আমিও ভীষণ – ভীষণ – উত্তেজনা বোধ করছিলাম।

কিন্তু, হল কী, আমার ক্যানসার ধরা পড়ল।

সত্যিই সে এক নিদারুণ কষ্ট। কিন্তু এর একটা সুন্দর দিকও ছিল, আমি আমার নিকটজনদের সঙ্গে যেন নতুন করে সংযুক্ত হলাম। আমার পরিজনরা, আমার আত্মীয়রা আমার দেখভাল করতে শুরু করল। আমাকে ঘিরে রইল তারা। তারা আমাকে ধরে ধরে সিঁড়ি বেয়ে ওঠাত। তারা আমাকে রেঁধে খাওয়াত। তারা আমার বাচ্চাদের দেখাশোনা করত। আর হাসপাতালে থাকার সময় আমি আরও অনেক বেশি সংযোগ ঘটিয়ে ফেললাম - সেগুলো যেন আরও জোরালো – আমার মতো আরও যে-মহিলাদের ব্রেস্ট ক্যানসার হয়েছে তাদের সঙ্গে।

আমাদের আতঙ্ক হত। সত্যিকারের আতঙ্ক। আমরা কাঁদতাম। আমরা হাসতামও বটে। আজও, প্রতিদিন। আমরা পরস্পর এত আঁট হয়ে রইলাম একে অপরের সঙ্গে যেন কাপড়ের ওপর গাঁথা একটা ট্যাপেস্ট্রির কাজ। যখনই কেউ হোঁচট খায়, কেউ টাল হারায়, বাকিরা তখনই ঠিক এসে দাঁড়ায় তার পাশে, তাকে ধরে তোলার জন্য। আর এসবের মধ্য দিয়ে আমি যা শিখলাম, সেটাই, সেটাই আমার অরণ্যভূমি আমাকে গোড়া থেকে বলে আসছিল – ভাল থাকার জন্য এই সংযোগটাই মোক্ষম জরুরি। এগুলো সহজে চোখে পড়ে না, কিন্তু এগুলো বাস্তব। আরও কি জানেন – আমি নিজেই তার জ্যান্ত প্রমাণ। আর এ জন্য আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ।

আমি এখন আবার আমার শক্তি ফিরে পেয়েছি, বিজ্ঞানের কাজে লেগেছি আবার। এবং অন্য আরও কিছু প্রশ্নের পিছু নিয়েছি।

আমার প্রথম, এবং সবথেকে জরুরি প্রশ্নটা হচ্ছে, আমাদের এই আবিষ্কার আজ আমাদের সামনে এসে দাঁড়ানো চরম বিপদের সাপেক্ষে কী বার্তা এনে দিতে পারে?

চরম বিপদটা হল ক্লাইমেট চেঞ্জ। জলবায়ু বদলাচ্ছে এবং সেটা কোনও ধাপ্পাবাজি নয়। সত্যি বলতে কী, নিজেদের ধোঁকা দিয়ে তো কোনও লাভ নেই – এমন কোনও বাহাদুরি ফলানো টেকনোলজি আমাদের নেই যা দিয়ে এই বিপর্যয় থেকে আমরা উদ্ধার পেতে পারি। আমার আবিষ্কার বলছে, আমার এই প্রশ্নের উত্তরটা, সমস্যার সমাধানটা লুকিয়ে আছে প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ভিতর।

কাজটা করার সময় আমি এখানকার আদিবাসীদের মাঝখানে গিয়েছিলাম। আমার গবেষণাটা আমি এই আদিবাসীদের, এখানে যাদের অ্যাবোরিজিনাল মানুষ বলে, তাদের সঙ্গে নিয়েই করছি। আপনারা জানেন নিশ্চয়, এদের জীবিকা নির্ভর করে স্যামন মাছের ওপর। স্যামন মাছের দেখাশোনার মধ্য দিয়ে এদের সঙ্গে মাছেদের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, যা তাদের নিজেদের জীবিকারও সহায়ক। তাদের বাঁচবার জন্যই এটা এক অপরিহার্য সম্পর্ক।

হেমন্তে, স্যামন মাছ যখন নদীতে ডিম পাড়তে আসে, নদীতে নেমে আসে ভাল্লুকের দল। আসে নেকড়ে। স্যামন মাছের আতুঁড় এই নদীগুলো থেকে তারা স্যামন মাছ ধরে খেতে থাকে। আর এই স্যামন তারা বয়ে নিয়ে যায় অরণ্যের ভেতর।

Plants4

সেখানে, আদিম জননী বৃক্ষের তলায়, জননী বৃক্ষের মেলে ধরা পাতার চাঁদোয়ার তলায়, তারা সেই স্যামন মাছ খায়। হেমন্তে তাদের উচ্ছিষ্ট পচে, গলে, মাটিতে চুঁইয়ে মিশে যেতে থাকে। আমরা মনে করি, ওই যে জননী বৃক্ষের সঙ্গে জড়িত মাইকোরাইজার সুবিস্তৃত জালিকাবিন্যাস, তারা এই নাইট্রোজেন শোষণ করে। বিজ্ঞানীরা গাছের গুঁড়িতে ছাপ-ফেলা বর্ষচক্রে এই স্যামন মাছ থেকে আসা নাইট্রোজেন আবিষ্কার করেছেন। বহু শতাব্দী ধরে সেগুলো সেখানে সঞ্চিত আছে।

এ বছর গ্রীষ্মে আমাদের পরিকল্পনা হল, আমরা আবার জঙ্গলে যাব, গিয়ে দেখব সেখানে সত্যিই মাদার ট্রি থেকে তার প্রতিবেশীদের ভেতর নাইট্রোজেন প্রবাহিত হচ্ছে কি না। আমাদের ধারণা এটাই ঘটছে। নাইট্রোজেন পৌঁছচ্ছে গাছ থেকে গাছে, সেখান থেকে আরও অন্য কোনও গাছে, গভীর থেকে গভীরতর অরণ্যে। আমরা মনে করি এর সঙ্গে অরণ্যের স্বাস্থ্যের সম্পর্ক জোড়া আছে। আর তার সঙ্গে জোড়া অবশ্যই নদীর স্বাস্থ্য, যেটার সঙ্গে যুক্ত স্যামনরা, যুক্ত রয়েছে স্যামন সমষ্টির সামগ্রিক স্বাস্থ্য, আর সেটা শেষ অবধি ঘুরে যাচ্ছে সমুদ্রে এবং ফিরে আসছে আমাদের কাছে। মানুষের কাছে।

তো, এই যে জীবনের চক্র, আমাদের অ্যাবোরিজিনাল পূর্বপুরুষরা যাকে বলতেন ‘অন্যোন্যক সম্পর্ক’, এটা বস্তুত পারস্পরিক সম্ভ্রমের আদানপ্রদান। বিজ্ঞানীরা যাকে বলছেন এখন ‘কমপ্লেক্স অ্যাডাপ্টিভ সিস্টেমস’, এটা তারই একটা ভাল উদাহরণ।

ভেবে দেখুন, অরণ্য দাঁড়িয়ে আছে পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর। তরতাজা একটা অরণ্যে সব কিছু সবকিছুর সঙ্গে সংযুক্ত, সবার সঙ্গে সবার বার্তা বিনিময় হচ্ছে।

এই ছবিতে প্রতিটা সংযোগবিন্দু এক-একটা প্রজাতি। তাদের সঙ্গে অবিরত অন্য সকলের সম্পর্ক স্থাপিত হচ্ছে। তাদের পারস্পরিক সংক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উদ্ভূত হচ্ছে যাকে বিজ্ঞানীরা বলছেন ‘কমপ্লেক্স অ্যাডাপ্টিভ বিহেভিয়ার’ (Complex Adaptive Behaviour), উচ্চতর সিস্টেম স্তরের গুণাবলি। যেমন সুস্থিতি, সুস্বাস্থ্য, পরিষ্কার বাতাস, পরিষ্কার জলের জোগান অক্ষুণ্ণ রাখা প্রাকৃতিক চক্র।

Plants6

কিন্তু আপনি জানেন, আধুনিক সমাজে আমরা মনে করি আমরা এসব থেকে আলাদা। আমরা বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত, আমরাই সেরা, অথবা ন্যূনতম বিচারে এই সমস্ত উপাদানকেই আমরা পড়ে পাওয়া বলে ধরে নিই।

কিন্তু ঘটনা হল, আমরা যখনই এর মধ্য থেকে মোক্ষম কয়েকটা উপাদানকে সরিয়ে দিই, যেমন ধরা যাক গ্রিজলি বেয়ার, কিংবা ধরা যাক যখন আমরা স্যামনের বংশকে ধ্বংস করে ফেলি তখনই এই সিস্টেমগুলো অতি দ্রুত বিনষ্ট হয়ে যেতে থাকে, সেগুলো ক্রমে হয়ে উঠতে থাকে যাকে আমরা বলি ‘উইকেড স্টেবল স্টেট’ (Wicked Stable State), দুষ্ট স্থিতাবস্থা।

কিন্তু সেটা তো আমাদের অভীষ্ট নয়। উইকেড স্টেবল স্টেটগুলোর কোনও ধরাবাঁধা নিশ্চয়তা থাকে না, সেগুলোর গতিপ্রকৃতি আগাম বলা যায় না। তুমি একটা কোনও সমস্যা সামলাতে যাবে তো এই দিকে আর-একটা সমস্যা ফুটে বেরবে। আর এখন ঘটনা যেদিকে গড়াচ্ছে, জঙ্গলগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মারা পড়ছে, এবং উল্টে সেটা আরও বেশি করে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটাচ্ছে, ফলে বলা চলে, সবকিছু ভীষণ দ্রুত বদলে যাচ্ছে।

কিন্তু এর মধ্যেই একটা ভাল জিনিস লুকিয়ে আছে। ঠিক যে-কারণে এগুলো কোনও পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকা এক-একটা কমপ্লেক্স অ্যাডাপ্টিভ সিস্টেম-এর লক্ষণ, সে-কারণেই আমরা পরিবর্তনের অভিমুখটাকে খারাপ থেকে ভালর দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারি।

কীভাবে সেটা করা যেতে পারে? প্রথমত, আমাদের নিজেদের দিকে নতুন দৃষ্টিতে তাকাতে হবে, মনে করতে হবে আমরা এই নেটওয়ার্কের অংশ। কল্পনা করুন আপনি যেন শুনতে পাচ্ছেন অন্য সমস্ত জীবের কথা। আমরা জমির নীচেকার নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারি, আমরা বহমান কথোপকথনের অংশ হয়ে উঠতে পারি। এটা যদি আমরা সত্যিই করতাম, আমাদের তো ওই অরণ্য থেকে - ডগলাস ফারের অরণ্য থেকে, বার্চ গাছগুলোকে কেটে বাদ দেওয়ার দরকার পড়ত না! কারণ আমাদের তখন নিশ্চিত জানা থাকত এর ফলে অরণ্যের স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হয়। অথচ আমরা এখনও সেটাই করে চলেছি।

Plants3

কিন্তু এখনও আমার মনে যথেষ্ট আশা আছে। আমি জানি, যদি আমরা এই কমপ্লেক্স অ্যাডাপ্টিভ সিস্টেমের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করতে পারি, এই যোগসূত্রে আমাদের ভূমিকাটা নির্ণয় করতে পারি, তবে আমাদের ভাবনার ধরনটাকে, আমাদের আচরণের ধারাকেই আমরা বদলে ফেলতে পারব। আমরা তখন এই সুবিশাল সিস্টেমের অঙ্গ হয়ে উঠব। মনে পড়ে, যেখানে বার্চ গাছ থেকে রসদ যাচ্ছিল ফারে, ফার থেকে ফের তা আসছিল বার্চে! মনে পড়ছে? তার মানে এটা থেকেই বোঝা যাচ্ছে, প্রকৃতিতে কোনও অসহিষ্ণুতা নেই, কেবল অন্যোন্যকতা আছে, কেবল পারস্পরিক সম্ভ্রম আছে - আমার ক্যানসারের বিপরীতে সহায়ক মানুষজনের মতো। এটাই আমাদের অনুশীলনের বিষয়।

আর-একবার ফিরে বলি, আমরা যখনই বুঝব আমরা প্রকৃতির মধ্যে ওতপ্রোতভাবে গাঁথা, আলাদা নই, অক্ষরে অক্ষরে এক, তখন আমরা এই সুবিপুল শক্তির অঙ্গ হয়ে উঠতে পারব, যা-কিছু সু, তার পথে চলতে পারব। প্রকৃতিকে একটা শপিং মল হিসেবে দেখা আমাদের বন্ধ করতে হবে। আর যদি সেটা করতে পারি, তবে ভবিষ্যতের পথরেখাটাও আমরা বদলে দিতে পারব।

একসময় মনে করতাম পরীরা অরণ্যের সঙ্গে সংযুক্ত, তারাই তার দেখভাল করে, এখন বুঝছি খুব একটা অন্যরকম কিছু ভাবিনি তখন। বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়েই আমি দেখিয়েছি যে, অদেখা এই যোগসূত্রগুলো সত্যিই রয়েছে। ঠিক যেমনটা কোস্ট স্যালিশ মানুষেরা আমাদের বরাবর বলে আসছিল। তারা আমাদের দেখিয়েছে, বিজ্ঞানও আমাদের দেখিয়েছে, সবকিছু সবকিছুর সঙ্গে সম্পর্কিত। সবকিছু সবকিছুর সঙ্গে কথা বলছে; সম্ভ্রমের সঙ্গে, পারস্পরিক অন্যোন্যক বোধের সঙ্গে। আমাদের সমাজের ভারসাম্যের মূল লুকিয়ে আছে এর ভেতর। তার মূল নীতিগুলো হল আত্মীয়তাবোধ, বয়স্কজনের প্রতি শ্রদ্ধা। তার থেকে জন্ম নেয় জটিল সম্পর্ক ও অভিযোজনের সামর্থ্য। এখান থেকেই আমরা পাই স্থিতিস্থাপকতা। জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিপর্যয়ের মোকাবিলা করতে যে-স্থিতিস্থাপকতার প্রয়োজন।

শেষতম আশার বার্তাটা হল এই, আমি আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে, বিজ্ঞানের চোখ দিয়ে একটা সারসত্য উপলব্ধি করেছি, যে উপলব্ধির অধিকারী আপনারাও। সেটা হল: আমরা সকলে এক।

[অনুবাদ: যুধাজিৎ দাশগুপ্ত]

সুজান সিমার (Suzanne Simard) ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় ফরেস্ট ইকোলজির অধ্যাপক। টেড-এক্স সিয়াটল এর সভায় এই বক্তৃতাটি (মূল শিরোনাম ছিল Nature's internet: how trees talk to each other in a healthy forest) তিনি করেছিলেন ২০১৬ সালে। ওপরের বয়ানটি ইউটিউব-এ সিমার-এর বক্তৃতার ভিডিও থেকে অনুবাদ করা। সঙ্গে ব্যবহৃত ছবিগুলিও সেখান থেকেই নেওয়া।

'টেড কনফারেন্স’ (টেকনোলজি, এন্টারটেনমেন্ট ডিজাইন) একটি আমেরিকান গণমাধ্যম সংগঠন। এঁদের আয়োজিত বিভিন্ন বক্তৃতা, যেসবের বিষয়, এঁদের স্লোগান অনুযায়ী, ‘আইডিয়াজ ওয়র্দ স্প্রেডিং’ - সেগুলো এঁরা অনলাইনে প্রকাশ করেন।

কোস্ট স্যালিশ: ব্রিটিশ কলাম্বিয়া, কানাডা ও আমেরিকায় বসবাসকারী এক জনজাতি

নতুন জাতের অসম্ভব

বরাবর যেটাকে অসম্ভব বলে জানি সেটাই যদি চোখের সামনে ঘটতে দেখি তবে চিন্তায় একটা ধাক্কা লাগে। আসলে অসম্ভবের সামনে দাঁড়ানোরও একটা ট্রেনিং লাগে। একজন বিজ্ঞানী এরকম অবস্থায় কী করেন? ধরা যাক বিজ্ঞানী একটা সমস্যার সামনে পড়েছেন, তবে সেটাকে তিনি ভাঙেন কীভাবে? তাঁর চিন্তা-হাতিয়ার কাজ করে কীভাবে? গত শতাব্দির সেরা পদার্থবিজ্ঞানী বলে ধরা হয় রিচার্ড ফাইনম্যানকে। পল স্টাইনহার্ড ছিলেন ফাইনম্যানের ছাত্র। ছাত্রাবস্থায় পদার্থবিজ্ঞান পড়ার রোমাঞ্চ তাঁর ভেতরে সঞ্চারিত করে দিয়েছিলেন ফাইনম্যান। সম্প্রতি প্রকাশিত একটা বইতে স্টাইনহার্ড লিখেছেন এক বিশেষ ধরনের ‘ক্রিস্টাল’ - কোয়াসিক্রিস্টাল আবিষ্কারের কথা। ক্রিস্টাল বলতে যে ধরনের পরমাণু-বিন্যাসের কথা আমরা ভাবি, কোয়াসিক্রিস্টাল তার থেকে একেবারে অন্য এক দুনিয়ার জিনিস। স্টাইনহার্ডের লেখায় সেই কোয়াসিক্রিস্টালের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ফাইনম্যানের প্রতিক্রিয়ার কথা পড়তে খুব মজা লাগছিল। ঠিক কী ধরনের পরিবেশ আর গুরু-শিষ্য সম্পর্ক বিজ্ঞান শেখার পক্ষে আদর্শ, তারও একটা ছবি মেলে এই লেখাটা থেকে।

নতুন জাতের অসম্ভব

ইমপসিবল!

গলাটা আমার চেনা। আমি চোখ বন্ধ করে শুনলেও সেই কিছুটা কর্কশ স্বর আর জিভে নিউ ইয়র্ক-মার্কা টানঅলা একেবারে অন্যরকমের গলাটা চিনতে ভুল করব না। আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন যিনি, তিনি আমার বিজ্ঞানচর্চার আদর্শ। এক কিংবদন্তী। রিচার্ড ফাইনম্যান। পরনে তাঁর মার্কামারা সাদা শার্ট, কাঁধ ছুঁয়ে নেমে এসেছে ধূসর চুলের গোছা, মুখে সেই হাত-পা অবশ করা শয়তান-শয়তান হাসি।

ফাইনম্যান নোবেল পেয়েছিলেন তাঁর যুগান্তকারী এক গবেষণার জন্য - তিনি আমাদের উপহার দিয়েছিলেন ইলেকট্রোম্যাগনেটিজমের কোয়ান্টাম তত্ত্ব। বিজ্ঞানীমহলে তিনি তখনই বিশ শতকের সেরা তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীর তকমা পেয়ে গেছেন। ক্রমশ আমজনতার মধ্যেও পড়ল তাঁর প্রভাব, তিনি হয়ে উঠলেন সকলের হিরো।

কীভাবে? চ্যালেঞ্জার স্পেস শাটলে যখন বিপর্যয় ঘটল তখন তার রহস্য উদ্ঘাটনে তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। আর সেইসঙ্গে যোগ হয়েছিল তাঁর লেখা দুটো বেস্টসেলার: সিওরলি ইউ আর জোকিং, মিঃ ফাইনম্যান! আর হোয়াট ডু ইউ কেয়ার হোয়াট আদার পিপল থিংক?

তাঁর ছিল এক আশ্চর্য মজারু-মার্কা সেন্স অফ হিউমার। আর খ্যাতি-কুখ্যাতি যাই বলি, সেটা রটেছিল তাঁর রীতিমতো আঁটঘাট বেঁধে করা প্র্যাকটিক্যাল জোকগুলোর সৌজন্যে। কিন্তু সায়েন্সের ব্যাপার এলেই ফাইনম্যান একেবারে আপোস না-মানা নিষ্ঠাবান মানুষ। সমালোচনায় নির্মম। ফলে কোনও সেমিনারে তিনি আছেন মানেই সেটা বেশ ভয়ের ব্যাপার। তাঁর বিচারে যদি কোনও কথাকে একচিলতে বেঠিক বা শিথিল মনে হয় তবে অবধারিতভাবে তিনি বক্তাকে তাঁর কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে সর্বসমক্ষে চ্যালেঞ্জ করে বসবেন।

ফাইনম্যান যে ওখানে উপস্থিত সেটা আমি গোড়া থেকেই বেশ সজাগ ভাবে লক্ষ করছিলাম। তিনি লেকচার হলে ঢুকলেন ঠিক আমার বক্তৃতা শুরুর আগে, এসে বসলেন সামনের সারিতে তাঁর বরাবরের পছন্দের সিটটাতে। যতক্ষণ বক্তৃতা চলেছে আমি চোখের কোণ দিয়ে তাঁকে টানা নজরে রেখেছি, মনে মনে ভাবছি এই বুঝি কোনও বিস্ফোরণ ঘটে। কিন্তু ফাইনম্যান একবারও আমাকে থামাননি, একটাও আপত্তি তোলেননি।

বক্তৃতা শেষ হবার পর ফাইনম্যান যেভাবে আমার মুখোমুখি উপস্থিত হলেন তাতে অন্য বহু বিজ্ঞানীর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যেত। তবে কিনা এটাই আমাদের প্রথম মুখোমুখি হওয়া নয়। আমার সৌভাগ্য যে ফাইনম্যানের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি আমি। সেটা প্রায় এক দশক আগের কথা, আমি তখন ক্যালটেকের আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ছাত্র। যারপরনাই গুণমুগ্ধ এবং তাঁর প্রতি নিবেদিতপ্রাণ এক ছাত্র। তিনি তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে, পড়ানোর মধ্য দিয়ে, সরাসরি পরামর্শ দিয়ে আমার জীবনটাই বদলে দিয়েছিলেন।

১৯৭০-এ আমি যখন এই প্রতিষ্ঠানে পড়তে এলাম, আমার লক্ষ্য ছিল হয় বায়োলজি নয় অঙ্ক নেব আমার মেজর সাবজেক্ট হিসেবে। হাইস্কুলে পড়তে ফিজিক্স আমার তেমন পছন্দের বিষয় ছিল না। তবে আমি জানতাম ক্যালটেকে যে কোনও বিষয়ের ছাত্রকেই ওটা পড়তে হয় দু বছর।

আসার পরপরই আমি বুঝে গেলাম বিষয়টা নচ্ছাররকমে কঠিন, আর সেটা কিছুটা বরাদ্দ টেক্সটবইটার জন্য। সে বইটা হল ফাইনম্যান লেকচারস অন ফিজিক্স-এর প্রথম খণ্ড। প্রথাসিদ্ধ টেক্সটবইয়ের মতো সেটা নয় মোটেই বরং বলা চলে ওটা দুর্দান্ত কিছু প্রবন্ধের সংকলন। ১৯৬০-এর দশকে পড়াতে গিয়ে ফাইনম্যান যেসব লেকচার দিয়েছিলেন তার ওপর ভিত্তি করে বইটা গড়া।

IMG_20200125_234901528

ফিজিক্স টেক্সটবইগুলোতে যেমন থাকে সচরাচর, ফাইনম্যান লেকচারস অন ফিজিক্স তেমন ছিল না মোটেই, কী করে ফিজিক্সের প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে সে বাবদ বিন্দুমাত্র কথা নেই সেখানে। ফলে হোমওয়ার্কে যেসব নিরেট সমস্যাগুলো ঘাড়ে চাপত সেগুলোর হিল্লে করা হয়ে উঠত মহা মুশকিলের ব্যাপার, আর সময়ও লাগত প্রচুর - কিন্তু প্রবন্ধগুলোতে আসলে যা ছিল তা সেসবের থেকে অনেক বেশি মূল্যবান। তা থেকে এমন এক অন্তর্দৃষ্টি পাওয়া যেত যা আসলে সায়েন্স সম্পর্কে ফাইনম্যানের ভাবনার নিজস্ব ধরনটার পরিচয় এনে দেয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ছাত্ররা ফাইনম্যান লেকচারস থেকে উপকার পেয়েছে। সেটাই আমাকে যেন একটা দিব্যদৃষ্টি এনে দিল।

কয়েক সপ্তাহ পরেই আমার মনে হতে লাগল যেন কেউ আমার মাথার খুলিটা খুলে মগজের তারগুলো নতুন করে সাজিয়ে জোড়া লাগিয়ে দিয়েছে। আমি ফিজিসিস্টদের মতো চিন্তা করতে শুরু করেছি, আর সত্যি বলতে কী, বেশ ভালও লাগছে। আমার প্রজন্মের আরও অনেক বিজ্ঞানীর মতোই আমিও যে ফাইনম্যানকে আমার হিরো বলে মেনেছি, এটা আমার কাছে গর্বের ব্যাপার। আগে যে ভেবেছিলাম বায়োলজি নয় অঙ্ক পড়ব, সেসব ভাবনা বিসর্জন দিয়ে আমি তেড়েফুঁড়ে ফিজিক্সের পিছু নিলাম।

কলেজের গোড়ার দিকের বছরগুলোতে আমি যখন ফ্রেশম্যান কোর্সে পড়ি, আমার মনে পড়ে, কয়েকবার আমি এমনকী কোনও সেমিনার শুরুর আগে কোনওমতে দমবন্ধ করে ফাইনম্যানের সামনে দাঁড়িয়ে ‘হ্যালো’ বলেছিলাম। ওইটুকুই। তার বেশি কিছু তখন কল্পনা করা যেত না। তবে, তার পরের ধাপে, যখন আমি জুনিয়র স্তরে পড়ি, আমার রুমমেট আর আমি, কোথা থেকে সাহস পেয়েছিলাম কে জানে, তাঁর অফিসের দরজায় টোকা দিয়ে ঢুকে বলেছিলাম তিনি মাঝেমধ্যে, ধরা যাক সপ্তাহে একবার, আমাদের মতো আন্ডারগ্র্যাজুয়েটদের জন্য রুটিনের বাইরে কিছু ক্লাস নিতে পারেন কি না। সেখানে আমরা তাঁকে তবে নানারকম বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারি। তাঁকে বলেছিলাম যে, পুরো ব্যাপারটা ইনফর্মাল থাকবে। হোমওয়ার্ক নয়, পরীক্ষা নয়, গ্রেড নয়, ক্রেডিট নয়। আমরা তখন জেনে গেছি তিনি একেবারে প্রথাবিরোধী মানুষ, কোনও রকম ব্যুরোক্র্যাসি দেখতে পারেন না। তাই আমাদের মনে হয়েছিল এটাকে একটা নিতান্ত নিয়মছাড়া আলগা ব্যাপার হিসেবে খাড়া করলে তাঁর মনে ধরতে পারে।

বছর দশেক আগে ফাইনম্যান ওরকম কিছু ক্লাস নিতেন, কিন্তু সেগুলো ছিল কেবলমাত্র প্রাথমিক শিক্ষার্থী অর্থাৎ ফ্রেশম্যানদের জন্য, আর তাও সেটা চলত বছরে কেবল তিন মাসের জন্য। আর এবার আমরা তাঁকে পুরো এক বছর ওরকম ক্লাস নেওয়ার কথা বলতে চলেছি, এবং সেটাতে থাকবে সমস্ত আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ছাত্ররা। বিশেষ করে থাকবে আমাদের মতো থার্ড আর ফোর্থ ইয়ারের ছাত্ররা, তারা তো স্বাভাবিকভাবেই বেশ কিছু অ্যাডভান্সড প্রশ্ন করতে চাইবে। আমরা বললাম, এই নতুন কোর্সটার নাম দেওয়া হোক ফিজিক্স এক্স - আগের কোর্সেরও এই নামই ছিল - যাতে সকলের কাছে এটা পরিষ্কার হয় যে, এখানে যা কিছু থাকবে সে সবই বইয়ের বাইরের জিনিস।

ফাইনম্যান কয়েকমুহূর্ত কী চিন্তা করলেন, তারপর বললেন ‘বেশ।’ সেই থেকে টানা তার পরের দু বছর প্রতি সপ্তাহে আমি আর আমার রুমমেট আরও কয়েক ডজন সৌভাগ্যবানের সঙ্গে সেইসব অবিস্মরণীয়, বুঁদ করে রাখা অপরাহ্ণ উপভোগ করতে থাকলাম।

প্রতিদিন ফিজিক্স এক্স-এর শুরুতে লেকচার হলে ঢুকতে ঢুকতে তিনি জিগ্যেস করতেন কারও কোনও প্রশ্ন আছে কিনা। কখনও কেউবা ফাইনম্যান যেসব বিষয়ে এক্সপার্ট তেমন কোনও বিষয়ে প্রশ্ন করতে চাইত। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর উত্তরগুলো হত একেবারে মোক্ষম। অন্য অনেক সময়ে আবার পরিষ্কার বোঝা যেত, ফাইনম্যান তেমন কোনও প্রশ্ন নিয়ে আগে কখনও ভাবেনইনি। সেসব মুহূর্ত আমার কাছে অসাধারণ ঠেকত কারণ আমি তার মধ্য দিয়েই সুযোগ পেতাম কীভাবে প্রথম কোনও একটা বিষয়ের মুখোমুখি হয়ে তিনি সেটা নিয়ে ভাবনা শুরু করেন, ভাবনাটাকে পেড়ে ফেলার চেষ্টা করেন সেটা বোঝার।

একবার, আমার স্পষ্ট মনে আছে, তাঁকে একটা কথা জিগ্যেস করেছিলাম যেটা আমার কাছে বরাবর বেশ রহস্যময় ঠেকত, কিন্তু শঙ্কাও ছিল যে, তাঁর চোখে সেটা হয়তো নিতান্ত মামুলি এক ব্যাপার। প্রশ্ন করেছিলাম, ‘ছায়ার রং কী?’

প্রায় এক মিনিট লেকচার ঘরের সামনের দিকটাতে পায়চারি করার পর ফাইনম্যান প্রশ্নটাকে ধরলেন। একেবারে ঘাড় কামড়ে। তিনি আলোচনা করতে থাকলেন ছায়ার ভেতর তার ঘনত্বের সূক্ষ্ম তারতম্য নিয়ে তারপর পড়লেন আলোর প্রকৃতি নিয়ে, তারপর এল আলোর অনুভূতির কথা, এরপর চাঁদের ছায়া, সেখান থেকে চাঁদের ওপর পৃথিবীর আলোকপাত যাকে বলি আর্থশাইন, সেখান থেকে এল চাঁদের জন্ম, সেখান থেকে... সেখান থেকে...। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম।

আমার সিনিয়র ইয়ারে ফাইনম্যান পরপর কয়েকটা রিসার্চ প্রোজেক্টে আমার শিক্ষক হতে রাজি হলেন। তখন আমি তাঁর কোনও সমস্যা মোকাবিলা করার ধরনটা আরও স্পষ্টভাবে দেখতে পেলাম। আর সেই সঙ্গে টের পেতে থাকলাম তাঁর কড়া সমালোচনার বহর, সেগুলো জুটত আমার কাজগুলো তাঁর উচ্চাশামাফিক না হলেই। আমি ভুল করলেই তাঁর ধারালো সব বিশেষণ ছুটে আসত: ‘ক্রেজি’, নাটস’, ‘রিডিকিউলাস’, ‘স্টুপিড’।

কড়া কথাগুলো প্রথম প্রথম খুব গায়ে লাগত, সন্দেহ জাগত যে আমি আদৌ থিয়োরেটিক্যাল ফিজিক্স পড়ার যোগ্য কি না। তবে এ-ও বুঝতাম, আমি তাঁর কড়া মন্তব্যগুলোকে যতটা সিরিয়াসলি নিচ্ছি, ফাইনম্যান ততটা বলেননি। কারণ পরের মুহূর্তেই তিনি নতুন একটা দিক থেকে সমস্যাটাকে ভাবার জন্য উৎসাহ দিতেন, বলতেন সেদিকে কিছুটা এগোলে আমি যেন আবার তাঁকে এসে দেখাই।

সবথেকে বড় ব্যাপারগুলো যা আমি ফাইনম্যানের কাছে শিখেছিলাম তার মধ্যে একটা হল, বিজ্ঞানের রোমাঞ্চকর বিস্ময়গুলোর বেশিরভাগই আমাদের রোজকার ঘটনার ভেতর থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। তোমাকে কেবল একটু সময় নিয়ে ব্যাপারগুলোকে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে হবে আর নিজের মনেই কিছু ভাল প্রশ্ন গড়ে তুলতে হবে। তাঁর প্রভাবেই আমার এই বিশ্বাসটাও গড়ে উঠেছিল যে, বাইরের চাপে কোনও একটা বিশেষ বিষয়ে সীমিত থাকার কোনও মানে হয় না, যেমনটা অবশ্য বহু বিজ্ঞানীই করে থাকেন। ফাইনম্যান আমাকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, যদি কৌতূহল টেনে নিয়ে যায় তবে বিচিত্র নানা বিষয়ে অনুসন্ধান চালানোয় কোনও ভুল নেই।

ক্যালটেকে আমার ফাইনাল টার্মের সময় আমাদের সাক্ষাৎ আলোচনা সংক্রান্ত একটা ঘটনা আমার বিশেষ করে মনে আছে। সেসময়ে সুপার বল নামে একটা জিনিসের খুব হিড়িক উঠেছিল – সেটা ছিল রাবার-রাবার পদার্থে তৈরি একটা সুপার-ইলাস্টিক বল। আমি সেই বলের আচরণ ব্যাখ্যা করার জন্য একটা গাণিতিক নকশা ভেবে বের করে সেটা তাঁকে বোঝাচ্ছিলাম।

ব্যাপারটা খুব চ্যালেঞ্জিং, কারণ প্রতিবার লাফিয়ে ওঠার সময় সুপার বলের গতির অভিমুখ বদলে যেত। আমি তাতে আরও একটা জটিলতা যোগ করেছিলাম, আমি দেখতে চাইছিলাম সুপার বলটা যদি বিভিন্ন কোণে হেলানো একটার পর একটা বিভিন্ন তলে লাফিয়ে বেড়ায়, তবে তার গতির চরিত্রটা আগাম বলতে পারি কি না। যেমন, বলটা যদি মেঝে থেকে টেবিলের তলায়, সেখান থেকে একটা হেলানো তলে, আবার সেখান থেকে দেওয়ালে লাফ দেয় তবে তার গতিপথটা কেমন হবে সেটা আমি হিসেব করে বের করেছিলাম। অর্থাৎ দেখাতে চেয়েছিলাম আপাতদৃষ্টিতে যেটা একেবারে এলোমেলো চলন সেটাকে ফিজিক্সের নিয়ম মেনে পুরোপুরি হিসেবে গাঁথা সম্ভব।

ফাইনম্যানকে আমি আমার গণনাটা দেখালাম। তাতে আগাম বলা ছিল যে, সুপার বলটাকে যদি একটা বিশেষ জটিল বিন্যাস মেনে সাজানো অনেকগুলো তল থেকে পরপর লাফ খাইয়ে আনি তবে সেটা শেষে আমার হাতেই ফিরে আসবে। আমি তাঁকে আমার গণনা করা কাগজটা দিলাম, তিনি একবার তাতে চোখ বোলালেন।

‘দ্যাটস ইমপসিবল!’

ইমপসিবল? আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম। তাঁর মুখে এটা একটা নতুন কথা। ‘ক্রেজি’ নয়, ‘স্টুপিড’ নয়! এই শব্দগুলোই তো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বর্ষিত হওয়ার কথা!

‘কেন ভাবছেন যে এটা ইমপসিবল?’ আমি একটু নার্ভাস ভাবেই জিগ্যেস করলাম।

ফাইনম্যান তাঁর সন্দেহের কারণটা ভেঙে বললেন। আমার ফরমুলা অনুযায়ী যদি কেউ সুপার বলটাকে একটা নির্দিষ্ট উচ্চতা থেকে একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় পাক খাইয়ে ছাড়তে পারে তাহলে লাফ খাওয়ার পর সেটা একেবারে মেঝে ঘেঁসে অতি ক্ষুদ্র কোণে পাশ বরাবর ঠিকরে যাবে।

‘আর সেটা ডাহা অসম্ভব, পল!’ তিনি বললেন।

আমি আমার সমীকরণগুলোর দিকে তাকালাম। ঠিকই, আমার গণনা অনুযায়ী বলটার লাফ খাওয়ার পর একটা ক্ষুদ্র কোণেই ঠিকরে যাওয়ার কথা। যদিও এটা আমাদের স্বাভাবিক ধারণার একেবারে বিপরীত, তবু আমার কাছে সেটাকে নিতান্ত অসম্ভব মনে হচ্ছিল না।

ততদিনে আমি প্রত্যুত্তর দেওয়ার মতো অভিজ্ঞ হয়েছি। ‘ঠিক আছে,’ আমি বললাম, ‘আমি যদিও আগে কখনও এটা নিয়ে পরীক্ষা করে দেখিনি, তবু, আপনার অফিসে একবার সে চেষ্টা করে দেখাই যেতে পারে।’

আমি আমার পকেট থেকে একটা সুপার বল বের করলাম। ফাইনম্যানের চোখের সামনে সেটাতে হিসেবমাফিক পাক খাইয়ে দিলাম ফেলে। ঠিক তাই, বলটা ঠিক আমার সমীকরণ যেমনটা পূর্বাভাস দিয়েছিল সেইমাফিক মেঝের সঙ্গে একটা সামান্য কোণে নির্ধারিত দিকে ঠিকরে বেরিয়ে গেল। ফাইনম্যানের চোখে যেটা অসম্ভব ছিল।

অবশ্য তক্ষুনি একলহমায় তিনি তাঁর ভুলটা ধরে ফেললেন। সুপার বলের চরম চটচটে ভাবটাকে তিনি তাঁর হিসেবে ধরেননি, বলের গতির ওপর স্পিনের প্রভাবটা নির্ভর করছিল সেটার ওপরেই।

‘হাউ স্টুপিড!’ বলেছিলেন ফাইনম্যান, বেশ জোর দিয়ে। আমার ভুল ধরার সময় গলায় ঠিক যে স্বরটা থাকত সেই স্বরে।

দু’বছর একসঙ্গে কাজ করার পর আমি শেষমেশ নিশ্চিত ধরতে পারলাম, ‘স্টুপিড’ হল এমন একটা বিশেষণ যেটা ফাইনম্যান সকলের বেলায় লাগাতেন, নিজেকেও বাদ দিতেন না। এর উদ্দেশ্য: যে-ভুলটা ঘটেছে সেটা যাতে আর দ্বিতীয়বার না ঘটে।

আমি এ-ও বুঝলাম, ‘ইমপসিবল’ শব্দটা ফাইনম্যান যেভাবে ব্যবহার করতেন তার মানে ‘আনঅ্যাচিভেবল’, বা ‘রিডিকিউলাস’ ছিল না। কখনও কখনও এর অর্থ ছিল ‘আরে বাঃ! এমনিতে যেটাকে ঠিক বলে জানি এই আশ্চর্য ব্যাপারটাতে তার উল্টোটাই তো ঘটছে। এটাকে তার মানে ভাল করে বোঝা দরকার!’

কাজেই, এসব ঘটনার ১১ বছর পর, ফাইনম্যান যখন আমার বক্তৃতার শেষে মুখে একটা হাসি নিয়ে রসিকতার ঢঙে আমার তত্ত্বটাকে ‘ইমপসিবল’ বললেন, আমি নিশ্চিত বুঝে নিলাম এর মাধ্যমে তিনি ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন। আমি বুঝলাম, তিনি বলতে চান যে, যেটা নিয়ে আমার বক্তৃতা - একেবারে নতুন ধরনের এক পদার্থ, যাকে বলা হয় কোয়াসিক্রিস্টাল (Quasicrystal), সেটা আমরা যাকে ঠিক বলে জানি তার উল্টোটা হাজির করছে। কাজেই ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং, এটাকে বোঝা দরকার।

ফাইনম্যান হেঁটে এলেন আমার টেবিলটার সামনে। সেখানে আমি আমার ভাবনাটাকে বোঝানোর জন্য একটা পরীক্ষা সাজিয়েছিলাম। তিনি সেটার দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘আমাকে এটা আবার দেখাও।’

আমি আর-একবার ডেমনস্ট্রেশন করার জন্য সুইচ টিপলাম, ফাইনম্যান স্থির হয়ে রইলেন। তিনি তাঁর নিজের চোখে তখন দেখছেন বিজ্ঞানের একটা বহুলপ্রতিষ্ঠিত নীতি কীভাবে ভেঙে যাচ্ছে। এটা এতই মৌলিক একটা ব্যাপার যে তাঁর ফাইনম্যান লেকচার–এ তিনি এটার বর্ণনা দিয়েছেন, আর সত্যি বলতে কী, গত প্রায় ২০০ বছর ধরে এই নিয়মটাই শেখানো হয়ে আসছে তরুণ বিজ্ঞানীদের।

কাজেই এই মুহূর্তে আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি রিচার্ড ফাইনম্যানের সামনে, তাঁকে বোঝাচ্ছি যে দীর্ঘপ্রচলিত এই নিয়মগুলো ভ্রান্ত।

কথা হল, ক্রিস্টালে যা যা আশা করি - তাতে নির্ধারিত নিয়মে সাজানো পরমাণুর বিন্যাস থাকবে, তা থেকে সূচিবিন্দু ডিফ্র্যাকশন নকশা তৈরি হবে – সেসব যে কেবল কোনও ক্রিস্টাল থেকেই পেতে হবে এমন কোনও কথা নেই। আমাদের সামনে এখন নতুন সম্ভাবনা নিয়ে এক বিপুল জগৎ এসে উপস্থিত হয়েছে, যে-জগতে এসবের স্বতন্ত্র নিয়মরীতি আছে। আমরা সে-জগতের পদার্থগুলোর নাম দিয়েছি কোয়াসিক্রিস্টাল।

এরকম নাম দেবার কারণ নতুন এই পদার্থটাকে আমরা সাধারণ ক্রিস্টালের থেকে আলাদা করে বোঝাতে চাই। উভয় পদার্থেই দেখা যাবে একই পরমাণুগুচ্ছ গোটা জিনিসটা জুড়ে পুনরাবৃত্ত হয়েছে।

ক্রিস্টালের পরমাণুগুচ্ছগুলো নির্দিষ্ট ব্যবধান অন্তর পুনরাবৃত্ত হয়। তার পাঁচরকমের প্যাটার্ন আমাদের জানা আছে। কোয়াসিক্রিস্টালের মধ্যে আলাদা আলাদা ধরনের গুচ্ছ তাদের যার-যার মতো নির্দিষ্ট স্বতন্ত্র ব্যবধানে পুনরাবৃত্ত হয়। আমাদের মনে ধরেছিল যেটা, সেটা হল দুই মাত্রার একটা প্যাটার্ন, যাকে বলা হয় পেনরোজ টাইলিং। পেনরোজ টাইলিং-এর প্যাটার্নটা অগতানুগতিক, সেখানে দুটো আলাদা ধরনের টাইলস থাকে, সেগুলোর এক-একটা যে-ব্যবধানে পুনরাবৃত্ত হয় তা অপরটার সঙ্গে কখনও ধাপে ধাপে মেলে না। গণিতবিদরা এ ধরনের প্যাটার্নকে বলেন কোয়াসিপিরিয়ডিক। সেখান থেকেই আমরা আমাদের আবিষ্কৃত এই তাত্ত্বিক জিনিসটার নাম দিয়েছিলাম কোয়াসিপিরিয়ডিক ক্রিস্টাল, বা সংক্ষেপে, কোয়াসিক্রিস্টাল।

আমার তত্ত্বের স্বপক্ষে সাজানো আমার ছোট্ট ডেমনস্ট্রেশনটা লেসার ফেলে দেখাচ্ছিলাম, আর ছিল কোয়াসিপিরিয়ডিক প্যাটার্নের ছবি দিয়ে তৈরি একটা স্লাইড। আমি ফাইনম্যানের কথামতো লেসারের সুইচটা টিপে দিলাম, আলোর বিমটাকে স্লাইডের ওপর এমনভাবে তাক করলাম যাতে সেটা তার ভেতর দিয়ে দূরের দেওয়ালে গিয়ে পড়ে। পরমাণুর অন্তর্বর্তী চ্যানেল দিয়ে এক্স-রে পাঠালে যা ঘটে, লেসার থেকেও ঠিক একইধরনের ঘটনা ঘটতে দেখা গেল, সৃষ্টি হল একটা ডিফ্র্যাকশন প্যাটার্ন।

আমি মাথার ওপরকার আলোটা নিভিয়ে দিয়েছিলাম যাতে ফাইনম্যান দেওয়ালের ওপর তৈরি হওয়া সূচিবন্দু আলো দিয়ে তৈরি অনেকটা তুষারকণার মতো দেখতে নকশাটাকে ভাল করে বুঝতে পারেন। ফাইনম্যান এর আগে যত ডিফ্র্যাকশন প্যাটার্ন দেখেছেন তার সঙ্গে এর কোনও মিল ছিল না।

আমি তাঁকে দেখালাম, যেমনটা বক্তৃতার সময়েও দেখিয়েছিলাম যে, সবথেকে উজ্জ্বল বিন্দুগুলো দশটা দশটা করে বিন্দুর এক-একটা বৃত্ত তৈরি করেছে, যেগুলো সমকেন্দ্রিক। এমনটা কেউ আগে শোনেনি। সূচিবিন্দু আলোর আরও কয়েকটা গুচ্ছ দেখা যাচ্ছিল সেগুলো এক-একটা পঞ্চভুজ তৈরি করেছে – বলতেই হবে যে তার মধ্য দিয়ে এমন একটা সিমেট্রির অস্তিত্ব প্রকাশ পাচ্ছে প্রকৃতির নিয়মে যার কোনও জায়গা নেই বলেই মনে করা হত। খুঁটিয়ে দেখলে ধরা পড়বে এই সূচিবিন্দুগুলোর মধ্যে আছে আরও অনেক বিন্দু এবং সেগুলোর মধ্যেও আছে আরও বিন্দু, তার মধ্যে আরও... আরও...

ফাইনম্যান স্লাইডটাকে ভাল করে দেখতে চাইলেন। আমি আলো নিভিয়ে স্লাইডের খাপ থেকে সেটাকে বার করে তাঁর হাতে দিলাম। স্লাইডের ভেতর ছবিটা এতই ছোট হয়ে আছে যে তার অনুপুঙ্খ বোঝা খুব মুশকিল ছিল, আমি তাই ওই টাইলিং প্যাটার্নের একটা বড় প্রিন্টও দিলাম, সেটাকে তিনি টেবিলের ওপর লেসারের সামনে নামিয়ে রাখলেন।

এর পরের কয়েক মুহূর্ত কাটল নিঃস্তব্ধতায়। আমার নিজেকে আবার ছাত্র বলে মনে হচ্ছিল, আমি যে উদ্ভট ভাবনা এনে হাজির করেছি ফের তার উত্তরে ফাইনম্যান কী বলেন সেটা জানার জন্য যেন অপেক্ষায় রয়েছি। তিনি টেবিলে রাখা বড় প্রিন্টটার দিকে চাইলেন, স্লাইডটাকে আবার তার খাপে ঢোকালেন, লেসারটা নিজেই অন করলেন। তাঁর চোখ ঘোরাঘুরি করতে থাকল টেবিলের বড়-করা প্রিন্টটায়, সেখান থেকে দেওয়ালে লেসার আলোয় তৈরি প্যাটার্নের দিকে, ফের টেবিলের প্রিন্টের দিকে।

‘ইমপসিবল!’ অবশেষে মুখ খুললেন ফাইনম্যান। আমি সায় দিয়ে মাথা নাড়লাম, মুখে হাসি ফুটল আমার, কারণ আমি জানি এই কথাটাই তাঁর সেরা প্রশংসাগুলোর অন্যতম।

তিনি দেওয়ালের দিকে ফিরে তাকালেন, মাথাটা ঝাঁকালেন। ‘অ্যাবসলিউটলি ইমপসিবল! দ্যাট ইজ ওয়ান অফ দ্য মোস্ট অ্যামেজিং থিংস আই হ্যাভ এভার সিন।’

আর তারপর একটাও কথা না বলে প্রফুল্ল মুখে আমার দিকে চেয়ে তাঁর রহস্যময় হাসিটা হাসলেন।

পল জে স্টাইনহার্ড প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে আলবার্ট আইনস্টাইন প্রফেসর ইন সায়েন্স। তিনি সেখানে ফিজিক্স এবং অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল সায়েন্স দুই বিষয়েরই অধ্যাপক পদে আছেন। আদি ব্রহ্মাণ্ড ও অভিনব ধর্মবিশিষ্ট পদার্থ সংক্রান্ত গবেষণার জন্য তিনি ডিরাক মেডাল এবং অন্য নানা সম্মান লাভ করেছেন।

রচনাটি স্টাইনহার্ডের লেখা The Second Kind of Impossible: The Extraordinary Quest for a New Form of Matter (Simon & Schuster, Inc., 2019) বইয়ের অংশবিশেষ। এই অংশটা নটিলাস পত্রিকার ৩১ জানুয়ারি ২০১৯-এ অনলাইন প্রকাশিত হয়েছিল।

কানামাছি ভোঁ ভোঁ

জীবনের নানাক্ষেত্রে কিছু সরল নীতি বানিয়ে নিয়ে আমাদের চলতে হয়। মেট্রো না পেলে বাসে ডানলপ ঘুরে যাব। রুই মাছের কিলো আড়াইশো টাকার বেশি দেখলে আজকের মতো চিকেন। দোকানদার পাঁচশো টাকা দাম চাইলে অন্তত কুড়ি পারসেন্ট কমিয়ে দরাদরি শুরু করব, হাজারের ওপর চাইলে অন্তত তিরিশ পারসেন্ট (এই সংখ্যাটা যিনি যত ভাল আঁচ করতে পারেন তিনি তত দুঁদে খরিদ্দার)। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ ধরনের নিয়ম আগে থেকে ভেবে রাখা থাকে। তাতে ঘটনার সময়ে মগজের ওপর চাপ পড়ে কম। ফলাফলও মেলে প্রত্যাশামাফিক, ঝঞ্ঝাট তেমন ঘটে না। কিন্তু সরল অ্যালগরিদমেরও কিছু ঝঞ্ঝাট আছে। এমন একধরনের ঝঞ্ঝাটের মুখে পড়েছিল আমাদের সকলের অতিপ্রিয় হুঁকোমুখো হ্যাংলা। বাঁদিকের ল্যাজে মাছি বসলে ডান ল্যাজ দিয়ে তাকে তাড়ানোই দস্তুর। ডানদিকে বসলে বাঁ-ল্যাজ ইস্তেমাল করতে হয়। অথচ ‘কিন্তু যদি কোনো পাজি বসে ঠিক মাঝামাঝি, কি যে করি ভেবে নাহি পাই রে’ - এ তারই খেদোক্তি। নীচের লেখায় আছে এরকমই একটা সরল অ্যালগরিদম থেকে জন্ম নেওয়া বিভ্রাটের কাহিনি। কানামাছির মতো দুটো সংখ্যা একে অপরকে টেক্কা দেবার চেষ্টা করছে, কিন্তু পরিণাম দাঁড়াচ্ছে ভয়াবহ। জন্ম নিতে চলেছে বিশ্বের সবথেকে দামি বই!

কানামাছি ভোঁ ভোঁ

পৃথিবীর সবথেকে দামি বইটার একটা কপি আমার কাছে আছে। আমার সামনেই টেবিল আলো করে রয়েছে এক কপি The Making of a Fly। জেনেটিকস বিষয়ে এটা একটা কলেজপাঠ্য অ্যাকাডেমিক বই। বেরিয়েছিল ১৯৯২তে। আমাজনে এটার দাম ধার্য হয়েছিল ২,৩৬,৯৮,৬৫৫.৯৩ ডলার (আরও ৩.৯৯ ডলার, ডাকে পাঠানোর খরচ)।

তবে হ্যাঁ, আমি বইটাকে বাগিয়েছি তাক-লাগানো ডিসকাউন্টে – ৯৯.৯৯৯৯২৩%! তাছাড়া যদ্দুর জানি বইটা কোনওদিনই ২ কোটি ৩০ লক্ষ ডলারে বিক্রি হয়নি, আমাজন বিপণিতে ওটার ওরকম একটা দাম টাঙানো হয়েছিল মাত্র। আর যদি তা হতও, তবু বহু মানুষ ন্যায্যতই যে-বইটাকে আজ অবধি বিক্রীত ‘মোস্ট এক্সপেনসিভ’ বই বলতে ধরেন সেটা হল লিওনার্দো দা ভিঞ্চির একটা জার্নাল। সেটা কিনেছিলেন - কে আর কিনবে, বিল গেটস ছাড়া! ‘মাত্র’ ৩ কোটি ৮ লক্ষ ডলারে। বুঝতেই পারছেন, বেমক্কা দামি পাঠ্যবস্তু সংগ্রহের ব্যাপারে বিল গেটস, আর আমি, দু’জনেরই শখ বেশ একরকম। কাজেই আমি ব্যাপারটাকে এভাবে দেখব বলে ভাবছি: দ্য মেকিং অফ আ ফ্লাই অন্তত একটা ব্যাপারে রেকর্ড করেছে, এটা হল বিশ্বের সমস্ত মোটে-তেমন-মাগ্গি-নয় বইয়ের ভেতর সব-থেকে-বেশি-দর-হাঁকা বই। যাক বাবা, আমার কপিটা আমি পেয়েছি মাত্র ১০.০৭ ডলারে। আর বই পাঠানোর খরচটা ওরা ধরেনি।

আমাজন-এ দ্য মেকিং অফ আ ফ্লাই-এর দামটা চড়চড় করে বাড়ল ২০১১য়, তখন এটা পাওয়া যাচ্ছিল মাত্র দু’টি পুস্তকবিক্রেতার কাছে: বর্ডিবুক (Bordeebook) আর প্রফন্যাট (Profnath)। আমাজনে বিক্রেতারা তাদের দাম বাড়ানো-কমানোর জন্য কিছু অ্যালগরিদম কাজে লাগায়। অনুমান করা যায়, প্রফন্যাট কাজে লাগিয়েছিল একটা সরল নিয়ম: ‘আমার বইয়ের দাম বাঁধো আমার দামের ঠিক ওপরের সস্তা বইটার থেকে ০.১৭ পারসেন্ট কম দামে’। মনে হয় তাদের কাছে দ্য মেকিং অফ আ ফ্লাইয়ের একটা কপি সত্যি সত্যি ছিল, তারা ভেবেছিল আমাজনে সবথেকে সস্তা দাম জানানোর মধ্য দিয়ে তারা বুঝি সামান্য লাভ রেখে বইটা বেঁচে দিতে পারবে।

উল্টোদিকে বর্ডিবুক-এর মতলব ছিল বেশ ভালমতো মার্জিন রেখে বইটার দাম চড়ানোর দিকে। তাদের রুলটা ছিল সম্ভবত এরকম: ‘আমাদের বইটার দাম বাঁধো সবথেকে সস্তা বইটার দাম থেকে ২৭ পারসেন্ট চড়িয়ে’। কেন তারা এরকম চেয়েছিল তার একটা কারণ আমার মনে হয় তাদের কাছে বইটার কোনও কপি আসলে ছিল না। কিন্তু তাদের ভরসা ছিল যে, কোনও ক্রেতা বইটা তাদের মারফত কিনতে চাইলে তারা বাজার ঢুঁড়ে অন্য কোনও বিক্রেতার কাছ থেকে খুঁজেপেতে সস্তা কপি জোগাড় করে ফেলতে পারবে। সেটা বিক্রি করলে তাদের মোটামুটি লাভও থাকবে। আসলে, বর্ডিবুক-এর মতো যেসব বিক্রেতার কাস্টমার রিভিউ খুবই ভাল তাদের দিকে ঝুঁকি-এড়াতে-চাওয়া ক্রেতাদের একটা টান থাকে, তার জন্য বেশি কড়ি গুনতে হলেও তারা অখুশি হয় না। বর্ডিবুক এটাকেই কাজে লাগাতে চেয়েছিল।

এখানে যদি আর অন্তত একটা বিক্রেতাও থাকত তার নির্ধারিত দাম সহ, তবে গোটা ব্যাপারটা নির্ঝঞ্ঝাটে চলতে পারত: প্রফন্যাট-এর বই তৃতীয় সেই বিক্রেতার থেকে সামান্য হলেও কম থাকত, আর বর্ডিবুক-এর বইটা থাকত বেশ ভালরকম চড়ার দিকে। কিন্তু যেহেতু দুটো ছাড়া অন্য কোনও বিক্রেতা ছিল না তাই গোটা ব্যাপারটা একটা সব্বনেশে চক্করে পড়ে গেল, একটা আর-একটার দাম ধাপে ধাপে বাড়িয়ে দিতে লাগল: ১.২৭×০.৯৯৮৩ = ১.২৬৮, অর্থাৎ অ্যালগরিদমের চাকা যেমন যেমন ঘুরতে থাকল, বইটার দাম প্রতি ধাপে ২৬.৮ পারসেন্ট করে বাড়তে থাকল, শেষমেশ পৌঁছে গেল কোটি ডলারের ঘরে। বোঝাই যাচ্ছে, অ্যালগরিদম দুটোর কোনওটাতেই বইটার দামের কোনও সীমা বাঁধা ছিল না, থাকলে দামটাকে হাস্যকর মাত্রায় উঠে যাওয়া থেকে বাঁচানো যেত। অবশেষে একসময় প্রফন্যাটই সম্ভবত ব্যাপারটা খেয়াল করেছিল (অথবা তাদের বেলায় মাথা-খারাপ-মার্কা হলেও কোনও সর্বোচ্চ সীমা হয়তো সত্যিই ছিল), কেননা তাদের দামটা একসময়ে ১০৬.২৩ ডলারে নেমে আসে, সেটা মোটামুটি স্বাভাবিক। এবং বর্ডিবুক-এর বইয়ের দামটাও তাল মিলিয়ে পড়ে যায়।

দ্য মেকিং অফ দ্য ফ্লাই-এর মারকাটারি দামটা খেয়াল করেছিল ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলি-র মাইকেল আইজেন* আর তার সতীর্থরা। ফ্রুট ফ্লাই তাদের গবেষণার কাজে লাগে, তাই কাজের প্রয়োজনেই এই বইটার দরকার পড়েছিল একসময়। কিন্তু দাম দেখে তারা রীতিমতো ঘাবড়ে গেল - বইটা একখানে বিক্রি হচ্ছে ১৭৩০০৪৫.৯১ ডলারে, অন্যখানে ২১৯৮১৭৭.৯৫ ডলারে, এবং দামটা প্রত্যেকদিন বাড়ছে। ফলে, বায়োলজি গবেষণা শিকেয় তুলে তারা বসল হিসেবের স্প্রেডশিট নিয়ে, সেখানে প্রতিদিন আমাজনে এগুলোর দামের ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড়টাকে বসাতে থাকল। প্রফন্যাট আর বর্ডিবুক দামের কী অনুপাতে তাদের অ্যালগরিদমটাকে বেঁধেছে সেই ধাঁধার সমাধান করতে বসল তারা (তারা বের করে ফেলল বর্ডিবুক খাপছাড়া হলেও নির্দিষ্টভাবে ২৭.০৫৮৯ পারসেন্ট বৃদ্ধি বরাদ্দ করেছিল) – এবং সেই সুবাদে স্পষ্ট বুঝে ফেলল জীবনে এমন কোনও সমস্যা নেই যা স্প্রেডশিট কাজে লাগিয়ে সমাধান না করা যায়।

মেকিং অফ আ ফ্লাই-এর বাজারটা একসময় ধাতস্থ হল। আইজেন-এর সতীর্থরা কালবিলম্ব না করে বইটার একটা কপি কিনে ফেলল, এবং বইয়ের দাম নির্ধারণের অ্যালগরিদমটাকে রিভার্স-ইঞ্জিনিয়ারিং করে বের করার পিছনে সময় নষ্ট না করে তারা আবার নামল জিন কীভাবে কাজ করে সেটা বোঝার কাজে। আমার হাতেও রইল আমার দ্য মেকিং অফ আ ফ্লাই-এর কপিটা (আমি ওটার একটা সেকেন্ড-হ্যান্ড কপি কিনেছিলাম। বুঝতেই পারছেন এমনকী ‘স্বাভাবিক দামে’ আমেরিকার কোনও টেক্সটবই কেনাও আমার বাজেটে কুলোয় না)। আমি এমনকী সাধ্যমতো চেষ্টাও করেছি সে বই পড়ে দেখার। আমি বুঝে দেখলাম, এই বইয়ের দামের বেলায় যা ঘটেছিল আর যেভাবে জিনের অ্যালগরিদম কাজে লাগিয়ে একটা মাছির শরীর গড়ে ওঠে, এ দুইয়ের মধ্যে কিছুটা হলেও মিল আছে। আমার শেষ কথাটা বইটা থেকেই তুলতে চাই। সবথেকে সেরা যেটা পেলাম সেটা এরকম:

বৃদ্ধির প্রকৃতি খুঁটিয়ে দেখলে এই ধারণাই জন্মাবে যে দেহের বিভিন্ন অংশে বেশ কিছু নিখুঁত গাণিতিক নিয়ন্ত্রণ কাজ করে চলেছে।
দ্য মেকিং অফ আ ফ্লাই, পিটার লরেন্স (পৃ ৫০)

আমার মনে হয় এই বিবৃতিটাতে আমাদের সকলের জন্যই কিছু না কিছু রয়েছে।

[অনুবাদ: যুধাজিৎ দাশগুপ্ত]

Humble Pi: A Comedy of Maths Errors, Matt Parker (Allen Lane, 2019) বইয়ের The Fly in the Algorithm অনু-অধ্যায়।

মাইকেল আইজেন এই বিষয়টা তাঁর ব্লগে লিখেছিলেন। বইয়ের অস্বাভাবিক দামটা তিনি তাঁর ব্লগে দেখিয়েছিলেন আমাজন থেকে স্ক্রিনশট নিয়ে। এখানে আমরা ওঁর ব্লগের একটা স্ক্রিনশট ব্যবহার করেছি।