কানামাছি ভোঁ ভোঁ

জীবনের নানাক্ষেত্রে কিছু সরল নীতি বানিয়ে নিয়ে আমাদের চলতে হয়। মেট্রো না পেলে বাসে ডানলপ ঘুরে যাব। রুই মাছের কিলো আড়াইশো টাকার বেশি দেখলে আজকের মতো চিকেন। দোকানদার পাঁচশো টাকা দাম চাইলে অন্তত কুড়ি পারসেন্ট কমিয়ে দরাদরি শুরু করব, হাজারের ওপর চাইলে অন্তত তিরিশ পারসেন্ট (এই সংখ্যাটা যিনি যত ভাল আঁচ করতে পারেন তিনি তত দুঁদে খরিদ্দার)। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ ধরনের নিয়ম আগে থেকে ভেবে রাখা থাকে। তাতে ঘটনার সময়ে মগজের ওপর চাপ পড়ে কম। ফলাফলও মেলে প্রত্যাশামাফিক, ঝঞ্ঝাট তেমন ঘটে না। কিন্তু সরল অ্যালগরিদমেরও কিছু ঝঞ্ঝাট আছে। এমন একধরনের ঝঞ্ঝাটের মুখে পড়েছিল আমাদের সকলের অতিপ্রিয় হুঁকোমুখো হ্যাংলা। বাঁদিকের ল্যাজে মাছি বসলে ডান ল্যাজ দিয়ে তাকে তাড়ানোই দস্তুর। ডানদিকে বসলে বাঁ-ল্যাজ ইস্তেমাল করতে হয়। অথচ ‘কিন্তু যদি কোনো পাজি বসে ঠিক মাঝামাঝি, কি যে করি ভেবে নাহি পাই রে’ - এ তারই খেদোক্তি। নীচের লেখায় আছে এরকমই একটা সরল অ্যালগরিদম থেকে জন্ম নেওয়া বিভ্রাটের কাহিনি। কানামাছির মতো দুটো সংখ্যা একে অপরকে টেক্কা দেবার চেষ্টা করছে, কিন্তু পরিণাম দাঁড়াচ্ছে ভয়াবহ। জন্ম নিতে চলেছে বিশ্বের সবথেকে দামি বই!

কানামাছি ভোঁ ভোঁ

পৃথিবীর সবথেকে দামি বইটার একটা কপি আমার কাছে আছে। আমার সামনেই টেবিল আলো করে রয়েছে এক কপি The Making of a Fly। জেনেটিকস বিষয়ে এটা একটা কলেজপাঠ্য অ্যাকাডেমিক বই। বেরিয়েছিল ১৯৯২তে। আমাজনে এটার দাম ধার্য হয়েছিল ২,৩৬,৯৮,৬৫৫.৯৩ ডলার (আরও ৩.৯৯ ডলার, ডাকে পাঠানোর খরচ)।

তবে হ্যাঁ, আমি বইটাকে বাগিয়েছি তাক-লাগানো ডিসকাউন্টে – ৯৯.৯৯৯৯২৩%! তাছাড়া যদ্দুর জানি বইটা কোনওদিনই ২ কোটি ৩০ লক্ষ ডলারে বিক্রি হয়নি, আমাজন বিপণিতে ওটার ওরকম একটা দাম টাঙানো হয়েছিল মাত্র। আর যদি তা হতও, তবু বহু মানুষ ন্যায্যতই যে-বইটাকে আজ অবধি বিক্রীত ‘মোস্ট এক্সপেনসিভ’ বই বলতে ধরেন সেটা হল লিওনার্দো দা ভিঞ্চির একটা জার্নাল। সেটা কিনেছিলেন - কে আর কিনবে, বিল গেটস ছাড়া! ‘মাত্র’ ৩ কোটি ৮ লক্ষ ডলারে। বুঝতেই পারছেন, বেমক্কা দামি পাঠ্যবস্তু সংগ্রহের ব্যাপারে বিল গেটস, আর আমি, দু’জনেরই শখ বেশ একরকম। কাজেই আমি ব্যাপারটাকে এভাবে দেখব বলে ভাবছি: দ্য মেকিং অফ আ ফ্লাই অন্তত একটা ব্যাপারে রেকর্ড করেছে, এটা হল বিশ্বের সমস্ত মোটে-তেমন-মাগ্গি-নয় বইয়ের ভেতর সব-থেকে-বেশি-দর-হাঁকা বই। যাক বাবা, আমার কপিটা আমি পেয়েছি মাত্র ১০.০৭ ডলারে। আর বই পাঠানোর খরচটা ওরা ধরেনি।

আমাজন-এ দ্য মেকিং অফ আ ফ্লাই-এর দামটা চড়চড় করে বাড়ল ২০১১য়, তখন এটা পাওয়া যাচ্ছিল মাত্র দু’টি পুস্তকবিক্রেতার কাছে: বর্ডিবুক (Bordeebook) আর প্রফন্যাট (Profnath)। আমাজনে বিক্রেতারা তাদের দাম বাড়ানো-কমানোর জন্য কিছু অ্যালগরিদম কাজে লাগায়। অনুমান করা যায়, প্রফন্যাট কাজে লাগিয়েছিল একটা সরল নিয়ম: ‘আমার বইয়ের দাম বাঁধো আমার দামের ঠিক ওপরের সস্তা বইটার থেকে ০.১৭ পারসেন্ট কম দামে’। মনে হয় তাদের কাছে দ্য মেকিং অফ আ ফ্লাইয়ের একটা কপি সত্যি সত্যি ছিল, তারা ভেবেছিল আমাজনে সবথেকে সস্তা দাম জানানোর মধ্য দিয়ে তারা বুঝি সামান্য লাভ রেখে বইটা বেঁচে দিতে পারবে।

উল্টোদিকে বর্ডিবুক-এর মতলব ছিল বেশ ভালমতো মার্জিন রেখে বইটার দাম চড়ানোর দিকে। তাদের রুলটা ছিল সম্ভবত এরকম: ‘আমাদের বইটার দাম বাঁধো সবথেকে সস্তা বইটার দাম থেকে ২৭ পারসেন্ট চড়িয়ে’। কেন তারা এরকম চেয়েছিল তার একটা কারণ আমার মনে হয় তাদের কাছে বইটার কোনও কপি আসলে ছিল না। কিন্তু তাদের ভরসা ছিল যে, কোনও ক্রেতা বইটা তাদের মারফত কিনতে চাইলে তারা বাজার ঢুঁড়ে অন্য কোনও বিক্রেতার কাছ থেকে খুঁজেপেতে সস্তা কপি জোগাড় করে ফেলতে পারবে। সেটা বিক্রি করলে তাদের মোটামুটি লাভও থাকবে। আসলে, বর্ডিবুক-এর মতো যেসব বিক্রেতার কাস্টমার রিভিউ খুবই ভাল তাদের দিকে ঝুঁকি-এড়াতে-চাওয়া ক্রেতাদের একটা টান থাকে, তার জন্য বেশি কড়ি গুনতে হলেও তারা অখুশি হয় না। বর্ডিবুক এটাকেই কাজে লাগাতে চেয়েছিল।

এখানে যদি আর অন্তত একটা বিক্রেতাও থাকত তার নির্ধারিত দাম সহ, তবে গোটা ব্যাপারটা নির্ঝঞ্ঝাটে চলতে পারত: প্রফন্যাট-এর বই তৃতীয় সেই বিক্রেতার থেকে সামান্য হলেও কম থাকত, আর বর্ডিবুক-এর বইটা থাকত বেশ ভালরকম চড়ার দিকে। কিন্তু যেহেতু দুটো ছাড়া অন্য কোনও বিক্রেতা ছিল না তাই গোটা ব্যাপারটা একটা সব্বনেশে চক্করে পড়ে গেল, একটা আর-একটার দাম ধাপে ধাপে বাড়িয়ে দিতে লাগল: ১.২৭×০.৯৯৮৩ = ১.২৬৮, অর্থাৎ অ্যালগরিদমের চাকা যেমন যেমন ঘুরতে থাকল, বইটার দাম প্রতি ধাপে ২৬.৮ পারসেন্ট করে বাড়তে থাকল, শেষমেশ পৌঁছে গেল কোটি ডলারের ঘরে। বোঝাই যাচ্ছে, অ্যালগরিদম দুটোর কোনওটাতেই বইটার দামের কোনও সীমা বাঁধা ছিল না, থাকলে দামটাকে হাস্যকর মাত্রায় উঠে যাওয়া থেকে বাঁচানো যেত। অবশেষে একসময় প্রফন্যাটই সম্ভবত ব্যাপারটা খেয়াল করেছিল (অথবা তাদের বেলায় মাথা-খারাপ-মার্কা হলেও কোনও সর্বোচ্চ সীমা হয়তো সত্যিই ছিল), কেননা তাদের দামটা একসময়ে ১০৬.২৩ ডলারে নেমে আসে, সেটা মোটামুটি স্বাভাবিক। এবং বর্ডিবুক-এর বইয়ের দামটাও তাল মিলিয়ে পড়ে যায়।

দ্য মেকিং অফ দ্য ফ্লাই-এর মারকাটারি দামটা খেয়াল করেছিল ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলি-র মাইকেল আইজেন* আর তার সতীর্থরা। ফ্রুট ফ্লাই তাদের গবেষণার কাজে লাগে, তাই কাজের প্রয়োজনেই এই বইটার দরকার পড়েছিল একসময়। কিন্তু দাম দেখে তারা রীতিমতো ঘাবড়ে গেল - বইটা একখানে বিক্রি হচ্ছে ১৭৩০০৪৫.৯১ ডলারে, অন্যখানে ২১৯৮১৭৭.৯৫ ডলারে, এবং দামটা প্রত্যেকদিন বাড়ছে। ফলে, বায়োলজি গবেষণা শিকেয় তুলে তারা বসল হিসেবের স্প্রেডশিট নিয়ে, সেখানে প্রতিদিন আমাজনে এগুলোর দামের ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড়টাকে বসাতে থাকল। প্রফন্যাট আর বর্ডিবুক দামের কী অনুপাতে তাদের অ্যালগরিদমটাকে বেঁধেছে সেই ধাঁধার সমাধান করতে বসল তারা (তারা বের করে ফেলল বর্ডিবুক খাপছাড়া হলেও নির্দিষ্টভাবে ২৭.০৫৮৯ পারসেন্ট বৃদ্ধি বরাদ্দ করেছিল) – এবং সেই সুবাদে স্পষ্ট বুঝে ফেলল জীবনে এমন কোনও সমস্যা নেই যা স্প্রেডশিট কাজে লাগিয়ে সমাধান না করা যায়।

মেকিং অফ আ ফ্লাই-এর বাজারটা একসময় ধাতস্থ হল। আইজেন-এর সতীর্থরা কালবিলম্ব না করে বইটার একটা কপি কিনে ফেলল, এবং বইয়ের দাম নির্ধারণের অ্যালগরিদমটাকে রিভার্স-ইঞ্জিনিয়ারিং করে বের করার পিছনে সময় নষ্ট না করে তারা আবার নামল জিন কীভাবে কাজ করে সেটা বোঝার কাজে। আমার হাতেও রইল আমার দ্য মেকিং অফ আ ফ্লাই-এর কপিটা (আমি ওটার একটা সেকেন্ড-হ্যান্ড কপি কিনেছিলাম। বুঝতেই পারছেন এমনকী ‘স্বাভাবিক দামে’ আমেরিকার কোনও টেক্সটবই কেনাও আমার বাজেটে কুলোয় না)। আমি এমনকী সাধ্যমতো চেষ্টাও করেছি সে বই পড়ে দেখার। আমি বুঝে দেখলাম, এই বইয়ের দামের বেলায় যা ঘটেছিল আর যেভাবে জিনের অ্যালগরিদম কাজে লাগিয়ে একটা মাছির শরীর গড়ে ওঠে, এ দুইয়ের মধ্যে কিছুটা হলেও মিল আছে। আমার শেষ কথাটা বইটা থেকেই তুলতে চাই। সবথেকে সেরা যেটা পেলাম সেটা এরকম:

বৃদ্ধির প্রকৃতি খুঁটিয়ে দেখলে এই ধারণাই জন্মাবে যে দেহের বিভিন্ন অংশে বেশ কিছু নিখুঁত গাণিতিক নিয়ন্ত্রণ কাজ করে চলেছে।
দ্য মেকিং অফ আ ফ্লাই, পিটার লরেন্স (পৃ ৫০)

আমার মনে হয় এই বিবৃতিটাতে আমাদের সকলের জন্যই কিছু না কিছু রয়েছে।

[অনুবাদ: যুধাজিৎ দাশগুপ্ত]

Humble Pi: A Comedy of Maths Errors, Matt Parker (Allen Lane, 2019) বইয়ের The Fly in the Algorithm অনু-অধ্যায়।

মাইকেল আইজেন এই বিষয়টা তাঁর ব্লগে লিখেছিলেন। বইয়ের অস্বাভাবিক দামটা তিনি তাঁর ব্লগে দেখিয়েছিলেন আমাজন থেকে স্ক্রিনশট নিয়ে। এখানে আমরা ওঁর ব্লগের একটা স্ক্রিনশট ব্যবহার করেছি।