কোন মুখোশ নিরাপদ?
আমার যদি করোনা-আক্রান্ত হওয়ার কোনও লক্ষণ না থাকে তাহলেও কি মুখোশ পরা উচিত? এই প্যানডেমিকের নানা সময়ে এই কথাটাই বারে বারে ঘুরেফিরে এসেছে। এতদিন পর্যন্ত এর উত্তরটাও ছিল সরল, অন্তত যদি আমরা আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)-এর কথা মেনে চলি। ৩ এপ্রিল পর্যন্ত সিডিসি এই প্রশ্নের উত্তরে বলছিল: না, মুখোশ পরার দরকার নেই।...
কিন্তু মাস্ক সম্পর্কে সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে এখন। ৩ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাধারণ মানুষকে সিডিসি-র নির্দেশ অনুসারে নন-মেডিক্যাল মাস্ক পরতে বলেছেন। বাড়ি থেকে যদি বেরতেই হয়, যেমন ধরা যাক দোকান-বাজার করতে, তবে মাস্ক পরা জরুরি। নন-মেডিক্যাল মাস্ক মানে হল নাক ও মুখ ঢাকা কাপড়ের মুখোশ। মাথায় বাঁধা ফেট্টি, যাকে ইংরেজিতে বলে ব্যানডানা, এবং টি-শার্ট তৈরি হয় যে-কাপড়ে সেরকম কিছু দিয়ে বানানো। এই সাবধানতা সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক।...
২৬ মার্চ আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজ-এর ডিরেক্টর অ্যান্টনি ফসি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘আমরা যখন বলছিলাম যে আপনার মুখোশ পরার দরকার নেই তখন আমরা আসলে বলতে চাইছিলাম মুখোশ পরার প্রয়োজন কার বেশি সেটা বুঝে নিয়ে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে মুখোশ পরা উচিত। কোনও আদর্শ পৃথিবীতে, যেখানে যত চাই তত মুখোশ মেলে, সেখানে কেউ মুখোশ পরে রাস্তায় হাঁটলে আমার কোনও আপত্তি থাকতে পারে না। ওটার মাধ্যমে আপনি তো কিছুটা বেশি সুরক্ষা পেতেই পারেন।’’
প্রশ্ন হল, মাস্ক কি সত্যিই নীরোগ মানুষকে সুস্থ থাকতে সাহায্য করবে? একটা টি-শার্টের কাপড় কি আমাকে রোগের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে? উত্তরগুলো নিয়ে কিছু জটিলতা আছে, সবটা এখনও বোঝা যায়নি। চিকিৎসকরা এবং মাস্কের উপযোগিতা নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন তাঁরা কী বলছেন দেখা যাক।
বিজ্ঞানীরা জানেন, নয়া করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, কিন্তু রোগের কোনও লক্ষণ তখনও যার মধ্যে ফোটেনি এমন মানুষেরাও সংক্রমণ ছড়াতে পারেন। (এ কথাটা রোগটা যখন দেখা দিল তখন জানা ছিল না।) সিডিসি-র ডিরেক্টর রবার্ট রেডফিল্ড সম্প্রতি এক সংবাদমাধ্যম, এনপিআর-কে দেওয়া একটা সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সংক্রমিত মানুষদের শতকরা ২৫জনের ভেতর রোগের কোনও লক্ষণ নাও দেখা যেতে পারে। যাদের শরীরে রোগের লক্ষণ দেখা দিচ্ছে তারাও ওই লক্ষণ দেখা দেওয়ার দুদিন আগে থাকতেই সম্ভবত রোগটা ছড়াতে থাকেন। ‘‘রোগটা কীভাবে দেশের ভেতর এতদূর ছড়িয়েছে তার একটা কারণ বোধহয় পাওয়া যাচ্ছে এখান থেকে।’’ বলেছেন রেডফিল্ড।
রোগটার এমন নীরব পদসঞ্চারের ফলে বাইরে বেরনো সমস্ত সাধারণ মানুষের মুখোশ পরার স্বপক্ষে যুক্তিটাই ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে, কারণ কে যে সংক্রমিত আর কে যে নয় তা বোঝা যাচ্ছে না।...
দুটো মতবাদেরই – অর্থাৎ এক, প্রত্যেক সাধারণ মানুষেরই মুখোশ পরা দরকার, আর দুই, সমস্ত আমআদমির মুখোশ পরার দরকার নেই – দু’পক্ষেরই যথেষ্ট গোঁড়া সমর্থক মজুত আছে। প্রথম দলে যাঁরা, তাঁরা দেখাচ্ছেন যে, ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো রোগাক্রান্ত মানুষদের থেকে রেহাই পেতে মুখোশ ব্যবহারের সুফল আছে – তা সে সুফল যত সামান্যই হোক না কেন, আর তার বৈজ্ঞানিক প্রমাণও আছে।
দ্বিতীয় দলে যাঁরা আছেন, তাঁরা মনে করেন, বৈজ্ঞানিক সাবুদ যা মিলছে তাতে পথেঘাটে মুখোশের কার্যকারিতাকে এমন মনে হচ্ছে না যে, প্রত্যেককে তা পরতে বলাটা যৌক্তিক কাজ হবে। বরং, ওটা পরে থাকলে লোকের মনে একটা ভ্রান্ত নিরাপত্তার ভাব তৈরি হতে পারে, তারা হয়তো অকারণ সাহসী হয়ে যেসব বিধিনিষেধ আসলে জরুরি এবং কার্যকর, সেগুলোকেই অগ্রাহ্য করতে থাকবে – যেমন, প্রত্যেকের সঙ্গে দূরত্ব রক্ষা করে চলা। তাঁরা আরও মনে করেন যে, মুখোশ পরা অবস্থায় তারা হয়তো অজান্তেই অনেক বেশি করে মুখে হাত দেবেন।
কানাডার সংক্রামক রোগের গবেষক-চিকিৎসক আইজাক বোগোচ বলছেন, ‘‘আমার মনে হয় আমাদের বেশ একটু সততার সঙ্গে স্বীকার করে নেওয়া ভাল যে, কিছু কিছু প্রমাণ থেকে ইঙ্গিত মিলছে, মাস্ক পরার সম্ভাব্য সুফল আছে। কিন্তু সেই সঙ্গে বেশ কিছু সতর্কতার অবকাশও জুড়ে আছে। ... এটা ভীষণ সত্যি যে, মাস্ক পরা বহু মানুষের বেলাতেই সেটা পরার যে-সুবিধে তা নষ্ট হবে যদি সে ভুল ধরনের মাস্ক পরে, কিংবা ধরা যাক যদি সে মাস্কটা ঠিকঠাক করে বসানোর জন্যই বারবার মুখে হাত ঠেকায়। যে মানুষটা দূরত্ব রাখার সব নিয়মকানুন ঠিকঠাক মানছে, যে অন্তত ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রাখছে অন্য মানুষেোর থেকে, তার বেলা মুখোশ পরাটা অতিরিক্ত কোনও সুবিধে দেবে না।’’
আমেরিকায় প্রয়োজনীয় মাস্কেরসরবরাহ এত কম যে স্বাস্থ্যকর্মীরাই করোনাভাইরাস রোগীদের সঙ্গে কাজ করার মতো পারসোনাল প্রোটেকটিভ ইউনিট (পিপিই) পাচ্ছে না। তার মধ্যে আছে এন-৯৫ রেস্পিরেটর (শক্ত করে মুখে আঁটা যায় এমন একটা মুখোশ তাতে হাঁচি-কাশি থেকে ছিটকে বেরনো অণুবিন্দু, যাতে ভাইরাস ব্যাকটিরিয়া লেগে থাকতে পারে, আটকে যায়। কিন্তু খুব সূক্ষ্ম কিছু আটকায় না)।
‘‘আমরা জানি যে, যারা স্বাস্থ্যপরিষেবা দিচ্ছে তাদেরই সংক্রমণের সম্ভাবনা অনেক বেশি, মানে, যে ধরনের কাজ এদের করতে হয় বা যে ধরনের রোগীদের নিয়ে করতে হয় তার ভিত্তিতে বলছি।’’ বলেছেন ড. এরিকা শেনয়, তিনি ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হসপিটালের ইনফেকশন কন্ট্রোল ইউনিটের অ্যাসোসোসিয়েট চিফ। মুখোশের ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে যখন হাত ধোওয়া, চোখ সুরক্ষিত রাখা, গ্লাভস আর গাউন পরা এইসব সতর্কতা পালন করা হয়, তখন স্বাস্থ্যকর্মীরা সত্যিই সুস্থ থাকতে পারেন, যেমন সুস্থ থেকেছেন কোভিড-১৯ রোগীদের সঙ্গে কাজ করার সময়।
মুখোশের টানাটানির দরুন আমেরিকা সরকার সাধারণ নাগরিকদের যে মুখোশ পরতে বলছেন তা এন-৯৫ বা সার্জিক্যাল মাস্ক নয়, বরং ঘরে বানানো মুখোশ। তবে, যদি একসময় টানাটানি মিটেও যায়, সকলে মুখোশ পরতেও পারে, তাতে সুরক্ষা আদৌ আসে কি না সেটাও জেনে নেওয়া দরকার।
আমাদের শ্বাসব্যবস্থাকে আক্রমণ করে এমন ভাইরাস আটকাতে সার্জিক্যাল মাস্ক কতটা কার্যকর তা নিয়ে বেশ কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছে। ‘‘এগুলোতে ধরা পড়েছে যে, অল্প কিছু সুফল এর সত্যিই আছে এবং মাস্ক পরার তেমন কোও ক্ষতিকর প্রভাবও নেই।’’ বলেছেন অ্যালিসন আয়েলো, ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ক্যারোলিনাতে এপিডেমিওলজির অধ্যাপক।২০১০-এ মুখোশের উপযোগিতা সংক্রান্ত একটা গবেষণাপত্রের তিনি সহলেখক। তাঁর করা একটা গবেষণার ফলাফল দেখাচ্ছে, ফ্লু চলছে এমন এক সময়ে কলেজের ছাত্রছাত্রীদের ওপর মাস্ক পরার তেমন কার্যকারিতা এমনিতে দেখা যায়নি, সুফল দেখা গেছে যখন মাস্ক পরার সঙ্গে সঙ্গে নিয়ম মেনে তারা হাতও ধুয়েছে।
২০০৯-এ প্রকাশিত আর-একাট গবেষণা হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ায়। ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো রোগে আক্রান্ত বাচ্চাদের দেখাশোনা করার সময় পরিবারের সদস্যরা যখন নিয়ম করে মুখোশ পরেছেন, দেখা গেছে তাঁরা নিজেরা কম আক্রান্ত হয়েছেন।
সিডিসি সম্প্রতি জানিয়েছে, চিকিৎসা-মানের মাস্ক যদি না পাওয়া যায় তাহলে স্বাস্থ্যকর্মীরা ঘরে তৈরি মুখোশ ব্যবহার করতে পারে, যেমন মাথায় বাঁধা ফেট্টি অর্থাৎ ব্যানডানা এবং স্কার্ফ। ‘‘অবশ্যই ঘরে তৈরি মাস্ককে পিপিই বলা চলবে না, কারণ সেগুলো কতটা সুরক্ষা দেয় তা এখনও অজানা।’’ এরকম জিনিস ব্যবহার করার সময় অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
ঘরে তৈরি মাস্ক আদপে নিরাপদ কি না তা নিয়ে ২০১৩য় একটা সমীক্ষা হয়েছিল। গবেষকরা ঘরেই মেলে এমন নানা কিছু দিয়ে মুখোশ বানিয়ে দেখছিলেন সেগুলো ব্যাকটেরিয়া আর ভাইরাস যুক্ত এরোসল (বাতাসে ভাসমান সূক্ষ্ম কণা) কতটা আটকাতে পারে, এবং সেই জিনিস দিয়ে বাস্তবে ব্যবহারোপযোগী মুখোশ কীভাবে বানানো যেতে পারে। তাঁদের পরীক্ষিত জিনিসগুলোর মধ্যে ছিল সুতির টি-শার্ট, স্কার্ফ, চা-পানের সময় ব্যবহৃত ছোট তোয়ালে, বালিশের ওয়াড়, ভ্যাকুয়াম ক্লিনারে ব্যবহৃত থলে। তাঁরা দেখলেন, সবথেকে কার্যকর মুখোশ বানানো যায় ১০০% সুতির টি-শার্ট দিয়ে কিংবা বালিশের ওয়াড় দিয়ে। তবে, টি-শার্টের কাপড়ের স্ট্রেচি-ভাবের কারণে তা দিয়ে বানানো মুখোশটা পরতে সুবিধে হয়। স্বেচ্ছাকর্মীরা টি-শার্ট দিয়ে নিজেরাই মুখোশ বানিয়ে (কীভাবে বানানো যায় তার উপায় দেখানে আছে এই রচনায়) তার মধ্য দিয়ে কেশে দেখছিলেন সেটা কেমন কাজ করে। তুলনার জন্য একইভাবে কাশির ফলাফল দেখা হয়েছিল সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার করে এবং কোনও মাস্ক ছাড়াই। দেখা গেছে ছোট ছোট সংক্রামক কণা আটকানোর কাজে টি-শার্ট দিয়ে বানানো মাস্ক সার্জিক্যাল মাস্কের মাত্র তিন ভাগের একভাগ কার্যকর।... ‘‘কিছু না থাকার চেয়ে এটা থাকা ভাল’’, বলেছেন আনা ডেভিস, এই গবেষকদলের একজন, তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন রিসার্চ কো-অর্ডিনেটর।
... তবে ঘরে তৈরি মাস্কে যে হিতে বিপরীত হতে পারে তেমন সম্ভাবনাও দেখা গেছে। অস্ট্রেলিয়ায় করা এক গবেষণায় দেখা গেছে মাস্ক ব্যবহারকারীরা যতটা নিয়ম মেনে তাদের মাস্কগুলো ধোয়ার কথা ছিল তেমনটা করেননি। রায়না ম্যাকইনটায়ার, অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে ইউনিভার্সিটি অফ নিউ সাউথ ওয়েলসের অধ্যাপক এবং উপরোক্ত গবেষণার সহযোগী, বলছেন, ‘‘আমরা জানতে পেরেছি মাস্কগুলো ভীষণ স্যাঁতসেঁতে, ভিজে ভিজে হয়ে পড়ে।’’ এবং ‘‘ভিজেভাবের কারণে সেখানে রোগজীবাণু বাড়তে থাকে। কাজেই লোকেরা যদি সেটা ঠিকঠাক না ধুয়ে ব্যবহার করে চলে তাহলে সংক্রমণের সম্ভাবনা তো থেকেই যায়। সাধারণ মানুষ যদি ঘরে তৈরি মাস্ক ব্যবহার করতেই চায় তাহলে তাতে একাধিক স্তর রেখে বানানো ভাল, এবং এমন কাপড় ব্যবহার করা উচিত যা জল টানে না।ব্যাপারটা এখনও অপরিষ্কার, কিন্তু আইয়েলো বলছেন, ‘‘কাপড়টা যেহেতু কিছুটা হলেও রোগ-ছড়ানো অণুবিন্দু ঠেকাতে পারে, কাজেই অন্তত খাতায়-কলমে ওই আড়ালটা সঙ্গে রাখাই ভাল, তাতে কোনও কোনও পরিস্থিতিতে কিছু কিছু সংক্রমণ তো আটকানো যেতেই পারে।’’
‘‘মুখোশ যদি পরতেই চাও তো পরো,’’ বোগোচ বলছেন, ‘‘কিন্তু এ থেকে সম্ভাব্য কী উপকার পাওয়া সম্ভব সেটা যেমন মনে রাখতে হবে তেমনই এর সীমাবদ্ধতাগুলো কী কী, জানতে হবে সেটাও। আর বাস্তববোধটাকে সজাগ রাখতে হবে।’’
[অনুবাদ: যুধাজিৎ দাশগুপ্ত]
ShouldHealthy People Wear Masks to Prevent Coronavirus? The Answer May Be Changing শিরোনামে এই রচনাটা বেরিয়েছে ৩ এপ্রিল ২০২০, টাইম পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে। এখানে তার নির্বাচিত অংশের অনুবাদ আছে