মহামারীর সুযোগে পরিবেশ-হননের ছাড়পত্র

ঠিক যে-সময়ে কোভিড-১৯ অতিমারীর কারণে সাধারণ মানুষের পক্ষে পরিবেশ-সুরক্ষার ওপর নজরদারি চালানো দুষ্কর হয়ে পড়েছে, জরুরি সরেজমিন সমীক্ষাগুলোও চালানো যাচ্ছে না ঠিক, তখনই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পরিবেশ-পর্যালোচনার নীতিগুলোকে শিথিল করে বড় বড় শিল্পপ্রকল্পগুলোকে ছাড়পত্র দেওয়ার উদ্যোগ নিল। ভারতের পরিবেশবাদীরা এর বিরুদ্ধে সমালোচনায় সরব হয়েছেন।

‘‘সরকারের ভাবটা এমন যেন এই মুহূর্তে জনস্বাস্থ্য আদৌ কোনও সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে না, তারা এরই মধ্যে মিটিং ডাকছে, সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বড় বড় প্রকল্পগুলো সমেত অন্যান্য উদ্যোগ সম্পর্কে’’, বলেছেন কাঞ্চী কোহলি, পরিবেশ-পরিচালন বিশেষজ্ঞ, ‘‘অথচ জনগণ যাতে ব্যাপারগুলোর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, যাতে সরেজমিনে অবস্থা যাচাই করা যায়, তার সমস্ত সুযোগ আগে থাকতেই বন্ধ।’’ কাঞ্চী কোহলি সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এর সঙ্গে যুক্ত আছেন।

অতিমারীর প্রকোপ কমানোর জন্য ২৬ মার্চ থেকে ভারত কঠোর লকডাউন অবস্থার মধ্যে রয়েছে। কিন্তু মিনিস্ট্রি অফ এনভায়রনমেন্ট, ফরেস্ট অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ-এ কাজকর্ম চলেছে যথারীতি। সেখানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিভিন্ন প্যানেলের নানা বৈঠক সারা হয়েছে যাতে খনি, পরিকাঠামো আর শিল্পকারখানা গড়ার একঢাল প্রকল্পকে ছাড় দেওয়া যায়।  গত কয়েক মাসের মধ্যে এই মন্ত্রক একটা হস্তী সংরক্ষণ অরণ্যে নতুন কয়লাখনি খোঁড়ার ছাড়পত্র দিয়েছে, তৈলকূপের জন্য প্রাথমিক ড্রিলিং-এর অনুমতি বিলানো হয়েছে এমন জায়গায় যা লায়ন-টেলড ম্যাকাক নামে বিপন্ন বানর আর গ্রেট ইন্ডিয়ান হর্নবিলের বাসভূমি। সেইসঙ্গে ছাড় পেয়েছে নয়াদিল্লির পার্লামেন্ট অঞ্চলটিকে ঢেলে সাজানোর বিতর্কিত পরিকল্পনাটি। আরও দুটো বিতর্কিত প্রকল্প নিয়ে এখন নাড়াচাড়া করা হচ্ছে: অরুণাচল প্রদেশের দিবাং ভ্যালি, যা বায়োডাইভার্সিটির ‘হটস্পট’, সেখানে একটা বিশাল জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, আর মধ্য ভারতের একটা ব্যাঘ্র প্রকল্পের ভেতর ইউরেনিয়াম খনি-প্রকল্প।

মন্ত্রকটি এইসঙ্গে ভারতের পরিবেশ সংক্রান্ত আইনের বেশ কয়েকটাকে ঢেলে সাজানোর দিকে এগোচ্ছে। বড় বড় প্রকল্প থেকে পরিবেশের সম্ভাব্য ক্ষতি পর্যালোচনার ব্যাপারে একটা নতুন খসড়া নীতি পেশ করা হয়েছে এ বছর ২৩ মার্চ তারিখে। এই খসড়ায় আরও অনেক প্রস্তাবের সঙ্গে এটাও যোগ করা হয়েছে যে, পরিবেশ পর্যালোচনার ওপর জনসাধারণের মন্তব্য জানানোর জন্য বরাদ্দ সময় কমিয়ে দেওয়া হবে। শুধু তাই নয়, তারও বেশি সংখ্যক প্রকল্পকে একেবারে জনমতের মুখোমুখি হওয়ার প্রক্রিয়াটা থেকেই রেহাই দেওয়া হয়েছে। এই প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলোর বিপক্ষ সমালোচকদের মত হল, এর ফলে যেসব প্রকল্প পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়াই কাজ শুরু করেছে তাদের প্রকারান্তরে অনুমতি দিয়ে দেওয়া হল।

মন্ত্রকটি এইসঙ্গে ভারতের পরিবেশ সংক্রান্ত আইনের বেশ কয়েকটাকে ঢেলে সাজানোর দিকে এগোচ্ছে। বড় বড় প্রকল্প থেকে পরিবেশের সম্ভাব্য ক্ষতি পর্যালোচনার ব্যাপারে একটা নতুন খসড়া নীতি পেশ করা হয়েছে এ বছর ২৩ মার্চ তারিখে। এই খসড়ায় আরও অনেক প্রস্তাবের সঙ্গে এটাও যোগ করা হয়েছে যে, পরিবেশ পর্যালোচনার ওপর জনসাধারণের মন্তব্য জানানোর জন্য বরাদ্দ সময় কমিয়ে দেওয়া হবে। শুধু তাই নয়, তারও বেশি সংখ্যক প্রকল্পকে একেবারে জনমতের মুখোমুখি হওয়ার প্রক্রিয়াটা থেকেই রেহাই দেওয়া হয়েছে। এই প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলোর বিপক্ষ সমালোচকদের মত হল, এর ফলে যেসব প্রকল্প পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়াই কাজ শুরু করেছে তাদের প্রকারান্তরে অনুমতি দিয়ে দেওয়া হল।

বিশ্লেষকদের মতে অতিমারী চলার মধ্যেই সরকারের তরফে শিল্পোদ্যোগের প্রকল্পগুলোকে এভাবে ঠেলে পার করে দেওয়ার চেষ্টাটি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাণিজ্যমহল-ঘেঁষা অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। যেমন, লিগ্যাল ইনিশিয়েটিভ ফর ফরেস্ট অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট সংস্থার বিশ্লেষণে ধরা পড়েছে, ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি এবং পার্কগুলির তত্ত্বাবধায়ক একটি বিশেষ প্যানেল ২০১৯-এর জানুয়ারি থেকে জুনের ভেতর ৭০টা উন্নয়ন প্রকল্পের ৬৩টাকেই ইতিমধ্যে ছাড় দিয়েছে, পরিণামে ২১৬ হেক্টর আয়তন প্রাকৃতিক ভূমিতে সংরক্ষণের অবনতি ঘটেছে। কোহলি উল্লেখ করেছেন, এই প্যানেলের মধ্যে কেবল মাত্র একজনই বিজ্ঞানী আছেন যিনি স্বাধীন। শ্রীমতী কোহলির মতে, ‘‘নানারকম দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ধারা কয়েক বছর হল ক্ষীণ হয়ে এসেছে।’’ তিনি বলেন, ‘‘প্রধান লক্ষ্য এখন ছাড় পাইয়ে দেওয়া, অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ বা মতবিনিময় চালু করা নয়।’’

কনজারভেশনিস্ট এবং বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, দিবাং ভ্যালি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বেলাতেও উন্নয়নমুখী দৃষ্টিভঙ্গিই প্রাধান্য পাবে। ৩০৯৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষম এই প্রকল্পটির জন্য প্রস্তাবিত জলাধারটি যেখানে তৈরি হবে সেখানে ৩০০ প্রজাতির পাখি, ৭৫টি প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর বাস। এখানকার অধিবাসী ইদু-মিশমি উপজাতির মানুষেরা এই প্রকল্পটির বিরোধিতা করছেন। এই অঞ্চলে এর আগে সরকারের তরফে একটা পরিবেশ-বিনাশ সম্ভাবনার পর্যালোচনা করা হয়েছিল। এই অঞ্চলে যেসব বিজ্ঞানী গবেষণা করছেন তাঁরা সেই প্রতিবেদনটিকে খুঁটিয়ে দেখেছেন। তাঁদের সুপারিশ হল, এখানে আরও বড় মাপে একটা পর্যালোচনা হওয়া উচিত, যা এই বাঁধটি এবং এটির মতো এখানে আরও যেসব বাঁধের পরিকল্পনা করা হয়েছে সেগুলো কীভাবে পরিবেশের ওপর কুপ্রভাব ফেলতে পারে তার অনুসন্ধান করবে। অরণ্যের দেখভাল ও পরিচালনার ব্যাপারে এখানকার ভূমিপুত্রদের মতামতকে আরও বেশি করে গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারে এই বিজ্ঞানীরা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে আসছেন। এই বিজ্ঞানীদের একটি গোষ্ঠী অরণ্য বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটিকে গতমাসে একটি লিখিত আবেদনে জানিয়েছে, ‘‘আমাদের সনির্বন্ধ অনুরোধ, এই দিকটাও ভেবে দেখুন’’, যাতে ‘‘এই নজিরবিহীন সামাজিক আর প্রাকৃতিক সংকটের মুহূর্তে ভারত আবার সত্যিকারের ইকোলজিকাল চ্যাম্পিয়ন হিসেবে বিশ্বকে পথ দেখাতে পারে।’’

[অনুবাদ: যুধাজিৎ দাশগুপ্ত]

প্রতিবেদনটি ‘সায়েন্স’ পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে ‘‘India’s push to relax environmental assessment rules amid pandemic draws criticism’’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল ৭ মে ২০২০ তারিখে। doi:10.1126/science.abc6828