নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে ভাইরাস!
আমেরিকার ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স (এন.এ.এস.) একটা অস্বস্তিকর ভাবনা উসকে দিল। এঁরা বলছেন, কেবল হাঁচি-কাশির সঙ্গে ছিটকে বেরনো অণুবৎ বিন্দু থেকে নয়, নয়া করোনাভাইরাস বাতাসে ভর করেও ছড়াতে পারে। যতটুকু গবেষণা হয়েছে তা থেকে নিশ্চিত কোনও বার্তা মিলছে না, কিন্তু হার্ভে ফাইনবার্গ লিখছেন, ‘‘যেসব পরীক্ষার ফলাফল হাতে এসেছে তাতে মনে হচ্ছে স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে ভাইরাস যে এরোসলে রূপান্তরিত হয়েও সংক্রমিত হতে পারে তার সমর্থন মিলেছে।’’ এরোসল হল এমন ক্ষুদ্র কণা যা বাতাসে দীর্ঘক্ষণ ভেসে থাকতে পারে। হার্ভে ফাইনবার্গ হলেন ‘ইমার্জিং ইনফেকশাস ডিজিজ অ্যান্ড টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি হেলথ থ্রেটস’ নামে এক কমিটির প্রধান। ওপরের বার্তাটি তিনি পাঠিয়েছেন হোয়াইট হাউস অফিস অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি পলিসি-র প্রধান কেলভিন ড্রোজেমেয়ারকে।
এতদিন অবধি আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সি.ডি.সি) এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যতত্ত্বাবধায়ক সংস্থাগুলো বলে আসছিল যে, সার্স-কভ-টু-র সংক্রমণের প্রাথমিক মাধ্যম হল অপেক্ষাকৃত বড় মাপের, ধরা যাক প্রায় ১ মিলিমিটার মাপের, অণুবৎ বিন্দু যা নাক-মুখ থেকে হাঁচি-কাশির সঙ্গে বেরিয়ে আসে। মাধ্যাকর্ষণের টানে এই বিন্দুগুলো দু-এক মিটার দূরত্ব পেরনোর আগেই মাটিতে পড়ে যায়। এ-ও ঠিক যে, যার ওপর বিন্দুগুলো পড়ে সেখান থেকে অন্য কারও হাতে লেগে যেতে পারে এবং নাকে মুখে বা চোখে হাত দেওয়ার মাধ্যমে সেসবের দ্বারাও সে মানুষটি আক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু যদি সত্যিই ধরা পড়ে যে, করোনাভাইরাস নিশ্বাসের সঙ্গে অতি হালকা যে-বাষ্প বেরয় তার ভেতরেও ভেসে থাকতে পারে, তবে মানতেই হবে অন্যদের পক্ষে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা বেশ দুরূহ কাজ। এটা সত্যি হলে জনসমক্ষে আসা প্রত্যেকে মানুষেরই মুখ-ঢাকা মুখোশ পরার পক্ষে যে-দাবিটা উঠেছে, সেটাও তখন জোর পেয়ে যাবে। যার দেহে রোগের লক্ষণ তখনও ফোটেনি অথচ যে এই ভাইরাসের বাহক, অজান্তে তার দ্বারা সংক্রমিত হওয়া ঠেকানোর জন্য এই মুখোশ ধারণ জরুরি হয়ে উঠবে।
বিতর্কের শুরু যখন নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন এই বছরের গোড়ায় একটা গবেষণার ফলাফল বের করে। সেই গবেষণা বলছে, সার্স-কভ-টু এরোসল বিন্দু হয়ে ভেসে থাকতে পারে। ৫ মাইক্রনেরও ছোট এই বিন্দুগুলো বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারে প্রায় ৩ ঘন্টা অবধি, এবং তাদের সংক্রামক চরিত্রও বজায় থাকে।
আরও একটি পরীক্ষার উল্লেখ করেছেন ফাইনবার্গ এবং এন এ এস-এর সতীর্থরা। তার একটা হল ইউনিভার্সিটি অফ নেব্রাস্কা মেডিক্যাল সেন্টারের জোশুয়া সান্তারপিয়া এবং তাঁর সতীর্থদের কাজ। তাঁরা দেখেছেন, কোভিড-১৯ রুগীদের আলাদা করে রাখা এক ঘরের বাতাসে ভাইরাসের আরএনএ রয়েছে। রোগীদের থেকে দুই মিটারেরও বেশি দূরত্বের বাতাসে ভাইরাস আরএনএ পাওয়া গেছে, এমনকী সেটা মিলেছে ঘরের যেসব কোনায় সহজে কারও নাগাল পৌঁছয় না সেখান থেকেও। তাঁরা বলছেন, আরএনএ থাকার অর্থই হল, ভাইরাসটা এরোসল বেয়েও ছড়াতে পারে। যদিও সরাসরি সংক্রামক কোনও ভাইরাস-কণা তাঁরা সেখানে পাননি।
আর-একটা গবেষণা-ফলাফলের প্রাক-প্রকাশ সংস্করণ থেকে এন.এ.এস.-এর প্রতিবেদক গোষ্ঠী কিছু আশঙ্কার সূত্র খুঁজে পেয়েছেন। তাঁরা দেখেছেন, স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণগুলো (পারসোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট, পি.পি.ই.) থেকেও সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের য়ুয়ান লিউ পরিচালিত এই গবেষকদল জানাচ্ছেন, স্বাস্থ্যকর্মীরা যখন তাঁদের পি.পি.ই. খুলে রাখেন, মেঝে পরিষ্কার করেন বা সংক্রমিত এলাকার মধ্য দিয়ে যান তখন তাদের শরীর থেকে বাতাসে সংক্রামক ভাইরাস ফিরে ঢোকার সম্ভাবনা রয়ে যায়। এন.এ.এস. প্রতিবেদকদের মতে, সব কিছু মিলিয়ে ভাবলে, ‘‘হাঁচিকাশি থেকে বাতাসে ঠিকরে আসা অণুবৎ বিন্দু এবং এরোসল, উভয়ের ভেতরেই ভাইরাস-আরএনএ খুঁজে পাওয়ার অর্থ হল, এই পথেও ভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে।’’
‘এরোসলাইজেশনের মতবাদটা যে গৃহীত হচ্ছে এটাই আমার কাছে একটা বড় স্বস্তি।’ বলেছেন কিম্বারলি প্রাথের, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সান দিয়েগো-র এক রসায়নবিদ। সায়েন্সইনসাইডার-কে পাঠানো একটা ই-মেলে তিনি বলেছেন, ‘এই বায়ুবাহী মাধ্যমটাকে হিসেবে ধরার ফলে বুঝতে সুবিধে হবে যে কেন এই সংক্রমণটা এত দ্রুত ছড়াচ্ছে।’’
মুখোশ পরার যুক্তিটাও জোর পাচ্ছে এর দ্বারা। এন.এ.এস. প্রতিবেদক গোষ্ঠী, হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যান্সি লিউং এবং তাঁর সতীর্থদের লেখা একটা গবেষণাপত্রের উল্লেখ করেছেন। ভাইরাসের সংক্রমণে শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হওয়া বেশ কিছু রোগীর হাঁচি-কাশি থেকে ছিটকে আসা অণুবৎ বিন্দু আর এই রোগীরা যে যেখানে আছেন তার বাতাসে ভাসমান পদার্থ এই গবেষকরা সংগ্রহ করেছিলেন। রোগীদের মধ্যে কয়েকজন সার্জিক্যাল মুখোশ পরেছিলেন। মুখোশ পরা থাকলে বাতাসে ভাসমান এরোসল এবং শ্বাসাঘাত-সৃষ্ট অণুবিন্দু দুটোতেই করোনাভাইরাসের আরএনএ কম পাওয়া গেছে। কিন্তু কেবল ইনফ্লুয়েঞ্জায় ভোগা মানুষদের হাঁচিকাশি নিঃসৃত অণুবিন্দুতেই এটা কম পাওয়া গেছে। গবেষকরা বলছেন, যাদের মধ্যে সংক্রমণের লক্ষণ ধরা পড়েছে তারা সার্জিক্যাল মুখোশ পরলে যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ আটকানো যেতে পারে তার স্বপক্ষে একটা কার্যকারণ-মানা প্রমাণ জোগাচ্ছে আমাদের পরীক্ষার ফলাফল।
এরোসল থেকে সংক্রমণ ছড়াতে পারে এটা অবশ্য বিশেষজ্ঞদের প্রত্যেকে মানতে নারাজ। ২৭ মার্চ হু (ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশন) একটা প্রতিবেদনে জানায়, কোনও কোনও বিশেষ অবস্থায় এরোসলের মাধ্যমে সংক্রমণ হয়তো বা সম্ভব, যেমন স্বাস্থ্যকর্মীরা যখন কোনও মারাত্মক অসুস্থ রোগীকে শ্বাস-নল পরাচ্ছেন। কিন্তু, হু-বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, চিনের ৭৫০০০-এরও বেশি করোনাভাইরাস আক্রান্তের উদাহরণ থেকে বলা যেতে পারে, কোনও ক্ষেত্রেই বাতাসবাহী সংক্রমণের কোনও প্রমাণ নেই। বিজ্ঞানী সানন্তারপিয়া প্রমুখের গবেষণা প্রসঙ্গে এই বিশেষজ্ঞদের মত হল, পিসিআর যন্ত্র মারফত বাতাসের নমুনা বিশ্লেষণ করে ভাইরাসের আরএনএ খুঁজে পাওয়ার অর্থ এই নয় যে, তাতে সংক্রমণ ঘটানোর যোগ্য ভাইরাস আছে।
তবে, এই বিতর্কের পর সি.ডি.সি. আপাতদৃষ্টিতে তাদের অবস্থানটাকে একটু ঝালিয়ে নিতে চলেছে। বেশ কয়েকটা সংবাদে প্রকাশ পেয়েছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আটকানোর জন্য এই সংস্থা আমেরিকার প্রত্যেককে জনসমক্ষে বেরনোর সময় মুখোশ পরার সুপারিশ করতে চলেছে।
[অনুবাদ: যুধাজিৎ দাশগুপ্ত]
২ এপ্রিল ২০২০ এই প্রতিবেদনটা You may be able to spreadcoronavirus just by breathing, new report finds শিরোনামে অনলাইন প্রকাশিত হয়েছে সায়েন্সম্যাগ-এ। সায়েন্সম্যাগের প্রকাশক ‘আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি অ্যাডভান্সমেন্ট অফ সায়েন্স’।