নতুন জাতের অসম্ভব

বরাবর যেটাকে অসম্ভব বলে জানি সেটাই যদি চোখের সামনে ঘটতে দেখি তবে চিন্তায় একটা ধাক্কা লাগে। আসলে অসম্ভবের সামনে দাঁড়ানোরও একটা ট্রেনিং লাগে। একজন বিজ্ঞানী এরকম অবস্থায় কী করেন? ধরা যাক বিজ্ঞানী একটা সমস্যার সামনে পড়েছেন, তবে সেটাকে তিনি ভাঙেন কীভাবে? তাঁর চিন্তা-হাতিয়ার কাজ করে কীভাবে? গত শতাব্দির সেরা পদার্থবিজ্ঞানী বলে ধরা হয় রিচার্ড ফাইনম্যানকে। পল স্টাইনহার্ড ছিলেন ফাইনম্যানের ছাত্র। ছাত্রাবস্থায় পদার্থবিজ্ঞান পড়ার রোমাঞ্চ তাঁর ভেতরে সঞ্চারিত করে দিয়েছিলেন ফাইনম্যান। সম্প্রতি প্রকাশিত একটা বইতে স্টাইনহার্ড লিখেছেন এক বিশেষ ধরনের ‘ক্রিস্টাল’ - কোয়াসিক্রিস্টাল আবিষ্কারের কথা। ক্রিস্টাল বলতে যে ধরনের পরমাণু-বিন্যাসের কথা আমরা ভাবি, কোয়াসিক্রিস্টাল তার থেকে একেবারে অন্য এক দুনিয়ার জিনিস। স্টাইনহার্ডের লেখায় সেই কোয়াসিক্রিস্টালের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ফাইনম্যানের প্রতিক্রিয়ার কথা পড়তে খুব মজা লাগছিল। ঠিক কী ধরনের পরিবেশ আর গুরু-শিষ্য সম্পর্ক বিজ্ঞান শেখার পক্ষে আদর্শ, তারও একটা ছবি মেলে এই লেখাটা থেকে।

নতুন জাতের অসম্ভব

ইমপসিবল!

গলাটা আমার চেনা। আমি চোখ বন্ধ করে শুনলেও সেই কিছুটা কর্কশ স্বর আর জিভে নিউ ইয়র্ক-মার্কা টানঅলা একেবারে অন্যরকমের গলাটা চিনতে ভুল করব না। আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন যিনি, তিনি আমার বিজ্ঞানচর্চার আদর্শ। এক কিংবদন্তী। রিচার্ড ফাইনম্যান। পরনে তাঁর মার্কামারা সাদা শার্ট, কাঁধ ছুঁয়ে নেমে এসেছে ধূসর চুলের গোছা, মুখে সেই হাত-পা অবশ করা শয়তান-শয়তান হাসি।

ফাইনম্যান নোবেল পেয়েছিলেন তাঁর যুগান্তকারী এক গবেষণার জন্য - তিনি আমাদের উপহার দিয়েছিলেন ইলেকট্রোম্যাগনেটিজমের কোয়ান্টাম তত্ত্ব। বিজ্ঞানীমহলে তিনি তখনই বিশ শতকের সেরা তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীর তকমা পেয়ে গেছেন। ক্রমশ আমজনতার মধ্যেও পড়ল তাঁর প্রভাব, তিনি হয়ে উঠলেন সকলের হিরো।

কীভাবে? চ্যালেঞ্জার স্পেস শাটলে যখন বিপর্যয় ঘটল তখন তার রহস্য উদ্ঘাটনে তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। আর সেইসঙ্গে যোগ হয়েছিল তাঁর লেখা দুটো বেস্টসেলার: সিওরলি ইউ আর জোকিং, মিঃ ফাইনম্যান! আর হোয়াট ডু ইউ কেয়ার হোয়াট আদার পিপল থিংক?

তাঁর ছিল এক আশ্চর্য মজারু-মার্কা সেন্স অফ হিউমার। আর খ্যাতি-কুখ্যাতি যাই বলি, সেটা রটেছিল তাঁর রীতিমতো আঁটঘাট বেঁধে করা প্র্যাকটিক্যাল জোকগুলোর সৌজন্যে। কিন্তু সায়েন্সের ব্যাপার এলেই ফাইনম্যান একেবারে আপোস না-মানা নিষ্ঠাবান মানুষ। সমালোচনায় নির্মম। ফলে কোনও সেমিনারে তিনি আছেন মানেই সেটা বেশ ভয়ের ব্যাপার। তাঁর বিচারে যদি কোনও কথাকে একচিলতে বেঠিক বা শিথিল মনে হয় তবে অবধারিতভাবে তিনি বক্তাকে তাঁর কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে সর্বসমক্ষে চ্যালেঞ্জ করে বসবেন।

ফাইনম্যান যে ওখানে উপস্থিত সেটা আমি গোড়া থেকেই বেশ সজাগ ভাবে লক্ষ করছিলাম। তিনি লেকচার হলে ঢুকলেন ঠিক আমার বক্তৃতা শুরুর আগে, এসে বসলেন সামনের সারিতে তাঁর বরাবরের পছন্দের সিটটাতে। যতক্ষণ বক্তৃতা চলেছে আমি চোখের কোণ দিয়ে তাঁকে টানা নজরে রেখেছি, মনে মনে ভাবছি এই বুঝি কোনও বিস্ফোরণ ঘটে। কিন্তু ফাইনম্যান একবারও আমাকে থামাননি, একটাও আপত্তি তোলেননি।

বক্তৃতা শেষ হবার পর ফাইনম্যান যেভাবে আমার মুখোমুখি উপস্থিত হলেন তাতে অন্য বহু বিজ্ঞানীর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যেত। তবে কিনা এটাই আমাদের প্রথম মুখোমুখি হওয়া নয়। আমার সৌভাগ্য যে ফাইনম্যানের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি আমি। সেটা প্রায় এক দশক আগের কথা, আমি তখন ক্যালটেকের আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ছাত্র। যারপরনাই গুণমুগ্ধ এবং তাঁর প্রতি নিবেদিতপ্রাণ এক ছাত্র। তিনি তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে, পড়ানোর মধ্য দিয়ে, সরাসরি পরামর্শ দিয়ে আমার জীবনটাই বদলে দিয়েছিলেন।

১৯৭০-এ আমি যখন এই প্রতিষ্ঠানে পড়তে এলাম, আমার লক্ষ্য ছিল হয় বায়োলজি নয় অঙ্ক নেব আমার মেজর সাবজেক্ট হিসেবে। হাইস্কুলে পড়তে ফিজিক্স আমার তেমন পছন্দের বিষয় ছিল না। তবে আমি জানতাম ক্যালটেকে যে কোনও বিষয়ের ছাত্রকেই ওটা পড়তে হয় দু বছর।

আসার পরপরই আমি বুঝে গেলাম বিষয়টা নচ্ছাররকমে কঠিন, আর সেটা কিছুটা বরাদ্দ টেক্সটবইটার জন্য। সে বইটা হল ফাইনম্যান লেকচারস অন ফিজিক্স-এর প্রথম খণ্ড। প্রথাসিদ্ধ টেক্সটবইয়ের মতো সেটা নয় মোটেই বরং বলা চলে ওটা দুর্দান্ত কিছু প্রবন্ধের সংকলন। ১৯৬০-এর দশকে পড়াতে গিয়ে ফাইনম্যান যেসব লেকচার দিয়েছিলেন তার ওপর ভিত্তি করে বইটা গড়া।

IMG_20200125_234901528

ফিজিক্স টেক্সটবইগুলোতে যেমন থাকে সচরাচর, ফাইনম্যান লেকচারস অন ফিজিক্স তেমন ছিল না মোটেই, কী করে ফিজিক্সের প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে সে বাবদ বিন্দুমাত্র কথা নেই সেখানে। ফলে হোমওয়ার্কে যেসব নিরেট সমস্যাগুলো ঘাড়ে চাপত সেগুলোর হিল্লে করা হয়ে উঠত মহা মুশকিলের ব্যাপার, আর সময়ও লাগত প্রচুর - কিন্তু প্রবন্ধগুলোতে আসলে যা ছিল তা সেসবের থেকে অনেক বেশি মূল্যবান। তা থেকে এমন এক অন্তর্দৃষ্টি পাওয়া যেত যা আসলে সায়েন্স সম্পর্কে ফাইনম্যানের ভাবনার নিজস্ব ধরনটার পরিচয় এনে দেয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ছাত্ররা ফাইনম্যান লেকচারস থেকে উপকার পেয়েছে। সেটাই আমাকে যেন একটা দিব্যদৃষ্টি এনে দিল।

কয়েক সপ্তাহ পরেই আমার মনে হতে লাগল যেন কেউ আমার মাথার খুলিটা খুলে মগজের তারগুলো নতুন করে সাজিয়ে জোড়া লাগিয়ে দিয়েছে। আমি ফিজিসিস্টদের মতো চিন্তা করতে শুরু করেছি, আর সত্যি বলতে কী, বেশ ভালও লাগছে। আমার প্রজন্মের আরও অনেক বিজ্ঞানীর মতোই আমিও যে ফাইনম্যানকে আমার হিরো বলে মেনেছি, এটা আমার কাছে গর্বের ব্যাপার। আগে যে ভেবেছিলাম বায়োলজি নয় অঙ্ক পড়ব, সেসব ভাবনা বিসর্জন দিয়ে আমি তেড়েফুঁড়ে ফিজিক্সের পিছু নিলাম।

কলেজের গোড়ার দিকের বছরগুলোতে আমি যখন ফ্রেশম্যান কোর্সে পড়ি, আমার মনে পড়ে, কয়েকবার আমি এমনকী কোনও সেমিনার শুরুর আগে কোনওমতে দমবন্ধ করে ফাইনম্যানের সামনে দাঁড়িয়ে ‘হ্যালো’ বলেছিলাম। ওইটুকুই। তার বেশি কিছু তখন কল্পনা করা যেত না। তবে, তার পরের ধাপে, যখন আমি জুনিয়র স্তরে পড়ি, আমার রুমমেট আর আমি, কোথা থেকে সাহস পেয়েছিলাম কে জানে, তাঁর অফিসের দরজায় টোকা দিয়ে ঢুকে বলেছিলাম তিনি মাঝেমধ্যে, ধরা যাক সপ্তাহে একবার, আমাদের মতো আন্ডারগ্র্যাজুয়েটদের জন্য রুটিনের বাইরে কিছু ক্লাস নিতে পারেন কি না। সেখানে আমরা তাঁকে তবে নানারকম বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারি। তাঁকে বলেছিলাম যে, পুরো ব্যাপারটা ইনফর্মাল থাকবে। হোমওয়ার্ক নয়, পরীক্ষা নয়, গ্রেড নয়, ক্রেডিট নয়। আমরা তখন জেনে গেছি তিনি একেবারে প্রথাবিরোধী মানুষ, কোনও রকম ব্যুরোক্র্যাসি দেখতে পারেন না। তাই আমাদের মনে হয়েছিল এটাকে একটা নিতান্ত নিয়মছাড়া আলগা ব্যাপার হিসেবে খাড়া করলে তাঁর মনে ধরতে পারে।

বছর দশেক আগে ফাইনম্যান ওরকম কিছু ক্লাস নিতেন, কিন্তু সেগুলো ছিল কেবলমাত্র প্রাথমিক শিক্ষার্থী অর্থাৎ ফ্রেশম্যানদের জন্য, আর তাও সেটা চলত বছরে কেবল তিন মাসের জন্য। আর এবার আমরা তাঁকে পুরো এক বছর ওরকম ক্লাস নেওয়ার কথা বলতে চলেছি, এবং সেটাতে থাকবে সমস্ত আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ছাত্ররা। বিশেষ করে থাকবে আমাদের মতো থার্ড আর ফোর্থ ইয়ারের ছাত্ররা, তারা তো স্বাভাবিকভাবেই বেশ কিছু অ্যাডভান্সড প্রশ্ন করতে চাইবে। আমরা বললাম, এই নতুন কোর্সটার নাম দেওয়া হোক ফিজিক্স এক্স - আগের কোর্সেরও এই নামই ছিল - যাতে সকলের কাছে এটা পরিষ্কার হয় যে, এখানে যা কিছু থাকবে সে সবই বইয়ের বাইরের জিনিস।

ফাইনম্যান কয়েকমুহূর্ত কী চিন্তা করলেন, তারপর বললেন ‘বেশ।’ সেই থেকে টানা তার পরের দু বছর প্রতি সপ্তাহে আমি আর আমার রুমমেট আরও কয়েক ডজন সৌভাগ্যবানের সঙ্গে সেইসব অবিস্মরণীয়, বুঁদ করে রাখা অপরাহ্ণ উপভোগ করতে থাকলাম।

প্রতিদিন ফিজিক্স এক্স-এর শুরুতে লেকচার হলে ঢুকতে ঢুকতে তিনি জিগ্যেস করতেন কারও কোনও প্রশ্ন আছে কিনা। কখনও কেউবা ফাইনম্যান যেসব বিষয়ে এক্সপার্ট তেমন কোনও বিষয়ে প্রশ্ন করতে চাইত। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর উত্তরগুলো হত একেবারে মোক্ষম। অন্য অনেক সময়ে আবার পরিষ্কার বোঝা যেত, ফাইনম্যান তেমন কোনও প্রশ্ন নিয়ে আগে কখনও ভাবেনইনি। সেসব মুহূর্ত আমার কাছে অসাধারণ ঠেকত কারণ আমি তার মধ্য দিয়েই সুযোগ পেতাম কীভাবে প্রথম কোনও একটা বিষয়ের মুখোমুখি হয়ে তিনি সেটা নিয়ে ভাবনা শুরু করেন, ভাবনাটাকে পেড়ে ফেলার চেষ্টা করেন সেটা বোঝার।

একবার, আমার স্পষ্ট মনে আছে, তাঁকে একটা কথা জিগ্যেস করেছিলাম যেটা আমার কাছে বরাবর বেশ রহস্যময় ঠেকত, কিন্তু শঙ্কাও ছিল যে, তাঁর চোখে সেটা হয়তো নিতান্ত মামুলি এক ব্যাপার। প্রশ্ন করেছিলাম, ‘ছায়ার রং কী?’

প্রায় এক মিনিট লেকচার ঘরের সামনের দিকটাতে পায়চারি করার পর ফাইনম্যান প্রশ্নটাকে ধরলেন। একেবারে ঘাড় কামড়ে। তিনি আলোচনা করতে থাকলেন ছায়ার ভেতর তার ঘনত্বের সূক্ষ্ম তারতম্য নিয়ে তারপর পড়লেন আলোর প্রকৃতি নিয়ে, তারপর এল আলোর অনুভূতির কথা, এরপর চাঁদের ছায়া, সেখান থেকে চাঁদের ওপর পৃথিবীর আলোকপাত যাকে বলি আর্থশাইন, সেখান থেকে এল চাঁদের জন্ম, সেখান থেকে... সেখান থেকে...। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম।

আমার সিনিয়র ইয়ারে ফাইনম্যান পরপর কয়েকটা রিসার্চ প্রোজেক্টে আমার শিক্ষক হতে রাজি হলেন। তখন আমি তাঁর কোনও সমস্যা মোকাবিলা করার ধরনটা আরও স্পষ্টভাবে দেখতে পেলাম। আর সেই সঙ্গে টের পেতে থাকলাম তাঁর কড়া সমালোচনার বহর, সেগুলো জুটত আমার কাজগুলো তাঁর উচ্চাশামাফিক না হলেই। আমি ভুল করলেই তাঁর ধারালো সব বিশেষণ ছুটে আসত: ‘ক্রেজি’, নাটস’, ‘রিডিকিউলাস’, ‘স্টুপিড’।

কড়া কথাগুলো প্রথম প্রথম খুব গায়ে লাগত, সন্দেহ জাগত যে আমি আদৌ থিয়োরেটিক্যাল ফিজিক্স পড়ার যোগ্য কি না। তবে এ-ও বুঝতাম, আমি তাঁর কড়া মন্তব্যগুলোকে যতটা সিরিয়াসলি নিচ্ছি, ফাইনম্যান ততটা বলেননি। কারণ পরের মুহূর্তেই তিনি নতুন একটা দিক থেকে সমস্যাটাকে ভাবার জন্য উৎসাহ দিতেন, বলতেন সেদিকে কিছুটা এগোলে আমি যেন আবার তাঁকে এসে দেখাই।

সবথেকে বড় ব্যাপারগুলো যা আমি ফাইনম্যানের কাছে শিখেছিলাম তার মধ্যে একটা হল, বিজ্ঞানের রোমাঞ্চকর বিস্ময়গুলোর বেশিরভাগই আমাদের রোজকার ঘটনার ভেতর থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। তোমাকে কেবল একটু সময় নিয়ে ব্যাপারগুলোকে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে হবে আর নিজের মনেই কিছু ভাল প্রশ্ন গড়ে তুলতে হবে। তাঁর প্রভাবেই আমার এই বিশ্বাসটাও গড়ে উঠেছিল যে, বাইরের চাপে কোনও একটা বিশেষ বিষয়ে সীমিত থাকার কোনও মানে হয় না, যেমনটা অবশ্য বহু বিজ্ঞানীই করে থাকেন। ফাইনম্যান আমাকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, যদি কৌতূহল টেনে নিয়ে যায় তবে বিচিত্র নানা বিষয়ে অনুসন্ধান চালানোয় কোনও ভুল নেই।

ক্যালটেকে আমার ফাইনাল টার্মের সময় আমাদের সাক্ষাৎ আলোচনা সংক্রান্ত একটা ঘটনা আমার বিশেষ করে মনে আছে। সেসময়ে সুপার বল নামে একটা জিনিসের খুব হিড়িক উঠেছিল – সেটা ছিল রাবার-রাবার পদার্থে তৈরি একটা সুপার-ইলাস্টিক বল। আমি সেই বলের আচরণ ব্যাখ্যা করার জন্য একটা গাণিতিক নকশা ভেবে বের করে সেটা তাঁকে বোঝাচ্ছিলাম।

ব্যাপারটা খুব চ্যালেঞ্জিং, কারণ প্রতিবার লাফিয়ে ওঠার সময় সুপার বলের গতির অভিমুখ বদলে যেত। আমি তাতে আরও একটা জটিলতা যোগ করেছিলাম, আমি দেখতে চাইছিলাম সুপার বলটা যদি বিভিন্ন কোণে হেলানো একটার পর একটা বিভিন্ন তলে লাফিয়ে বেড়ায়, তবে তার গতির চরিত্রটা আগাম বলতে পারি কি না। যেমন, বলটা যদি মেঝে থেকে টেবিলের তলায়, সেখান থেকে একটা হেলানো তলে, আবার সেখান থেকে দেওয়ালে লাফ দেয় তবে তার গতিপথটা কেমন হবে সেটা আমি হিসেব করে বের করেছিলাম। অর্থাৎ দেখাতে চেয়েছিলাম আপাতদৃষ্টিতে যেটা একেবারে এলোমেলো চলন সেটাকে ফিজিক্সের নিয়ম মেনে পুরোপুরি হিসেবে গাঁথা সম্ভব।

ফাইনম্যানকে আমি আমার গণনাটা দেখালাম। তাতে আগাম বলা ছিল যে, সুপার বলটাকে যদি একটা বিশেষ জটিল বিন্যাস মেনে সাজানো অনেকগুলো তল থেকে পরপর লাফ খাইয়ে আনি তবে সেটা শেষে আমার হাতেই ফিরে আসবে। আমি তাঁকে আমার গণনা করা কাগজটা দিলাম, তিনি একবার তাতে চোখ বোলালেন।

‘দ্যাটস ইমপসিবল!’

ইমপসিবল? আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম। তাঁর মুখে এটা একটা নতুন কথা। ‘ক্রেজি’ নয়, ‘স্টুপিড’ নয়! এই শব্দগুলোই তো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বর্ষিত হওয়ার কথা!

‘কেন ভাবছেন যে এটা ইমপসিবল?’ আমি একটু নার্ভাস ভাবেই জিগ্যেস করলাম।

ফাইনম্যান তাঁর সন্দেহের কারণটা ভেঙে বললেন। আমার ফরমুলা অনুযায়ী যদি কেউ সুপার বলটাকে একটা নির্দিষ্ট উচ্চতা থেকে একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় পাক খাইয়ে ছাড়তে পারে তাহলে লাফ খাওয়ার পর সেটা একেবারে মেঝে ঘেঁসে অতি ক্ষুদ্র কোণে পাশ বরাবর ঠিকরে যাবে।

‘আর সেটা ডাহা অসম্ভব, পল!’ তিনি বললেন।

আমি আমার সমীকরণগুলোর দিকে তাকালাম। ঠিকই, আমার গণনা অনুযায়ী বলটার লাফ খাওয়ার পর একটা ক্ষুদ্র কোণেই ঠিকরে যাওয়ার কথা। যদিও এটা আমাদের স্বাভাবিক ধারণার একেবারে বিপরীত, তবু আমার কাছে সেটাকে নিতান্ত অসম্ভব মনে হচ্ছিল না।

ততদিনে আমি প্রত্যুত্তর দেওয়ার মতো অভিজ্ঞ হয়েছি। ‘ঠিক আছে,’ আমি বললাম, ‘আমি যদিও আগে কখনও এটা নিয়ে পরীক্ষা করে দেখিনি, তবু, আপনার অফিসে একবার সে চেষ্টা করে দেখাই যেতে পারে।’

আমি আমার পকেট থেকে একটা সুপার বল বের করলাম। ফাইনম্যানের চোখের সামনে সেটাতে হিসেবমাফিক পাক খাইয়ে দিলাম ফেলে। ঠিক তাই, বলটা ঠিক আমার সমীকরণ যেমনটা পূর্বাভাস দিয়েছিল সেইমাফিক মেঝের সঙ্গে একটা সামান্য কোণে নির্ধারিত দিকে ঠিকরে বেরিয়ে গেল। ফাইনম্যানের চোখে যেটা অসম্ভব ছিল।

অবশ্য তক্ষুনি একলহমায় তিনি তাঁর ভুলটা ধরে ফেললেন। সুপার বলের চরম চটচটে ভাবটাকে তিনি তাঁর হিসেবে ধরেননি, বলের গতির ওপর স্পিনের প্রভাবটা নির্ভর করছিল সেটার ওপরেই।

‘হাউ স্টুপিড!’ বলেছিলেন ফাইনম্যান, বেশ জোর দিয়ে। আমার ভুল ধরার সময় গলায় ঠিক যে স্বরটা থাকত সেই স্বরে।

দু’বছর একসঙ্গে কাজ করার পর আমি শেষমেশ নিশ্চিত ধরতে পারলাম, ‘স্টুপিড’ হল এমন একটা বিশেষণ যেটা ফাইনম্যান সকলের বেলায় লাগাতেন, নিজেকেও বাদ দিতেন না। এর উদ্দেশ্য: যে-ভুলটা ঘটেছে সেটা যাতে আর দ্বিতীয়বার না ঘটে।

আমি এ-ও বুঝলাম, ‘ইমপসিবল’ শব্দটা ফাইনম্যান যেভাবে ব্যবহার করতেন তার মানে ‘আনঅ্যাচিভেবল’, বা ‘রিডিকিউলাস’ ছিল না। কখনও কখনও এর অর্থ ছিল ‘আরে বাঃ! এমনিতে যেটাকে ঠিক বলে জানি এই আশ্চর্য ব্যাপারটাতে তার উল্টোটাই তো ঘটছে। এটাকে তার মানে ভাল করে বোঝা দরকার!’

কাজেই, এসব ঘটনার ১১ বছর পর, ফাইনম্যান যখন আমার বক্তৃতার শেষে মুখে একটা হাসি নিয়ে রসিকতার ঢঙে আমার তত্ত্বটাকে ‘ইমপসিবল’ বললেন, আমি নিশ্চিত বুঝে নিলাম এর মাধ্যমে তিনি ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন। আমি বুঝলাম, তিনি বলতে চান যে, যেটা নিয়ে আমার বক্তৃতা - একেবারে নতুন ধরনের এক পদার্থ, যাকে বলা হয় কোয়াসিক্রিস্টাল (Quasicrystal), সেটা আমরা যাকে ঠিক বলে জানি তার উল্টোটা হাজির করছে। কাজেই ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং, এটাকে বোঝা দরকার।

ফাইনম্যান হেঁটে এলেন আমার টেবিলটার সামনে। সেখানে আমি আমার ভাবনাটাকে বোঝানোর জন্য একটা পরীক্ষা সাজিয়েছিলাম। তিনি সেটার দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘আমাকে এটা আবার দেখাও।’

আমি আর-একবার ডেমনস্ট্রেশন করার জন্য সুইচ টিপলাম, ফাইনম্যান স্থির হয়ে রইলেন। তিনি তাঁর নিজের চোখে তখন দেখছেন বিজ্ঞানের একটা বহুলপ্রতিষ্ঠিত নীতি কীভাবে ভেঙে যাচ্ছে। এটা এতই মৌলিক একটা ব্যাপার যে তাঁর ফাইনম্যান লেকচার–এ তিনি এটার বর্ণনা দিয়েছেন, আর সত্যি বলতে কী, গত প্রায় ২০০ বছর ধরে এই নিয়মটাই শেখানো হয়ে আসছে তরুণ বিজ্ঞানীদের।

কাজেই এই মুহূর্তে আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি রিচার্ড ফাইনম্যানের সামনে, তাঁকে বোঝাচ্ছি যে দীর্ঘপ্রচলিত এই নিয়মগুলো ভ্রান্ত।

কথা হল, ক্রিস্টালে যা যা আশা করি - তাতে নির্ধারিত নিয়মে সাজানো পরমাণুর বিন্যাস থাকবে, তা থেকে সূচিবিন্দু ডিফ্র্যাকশন নকশা তৈরি হবে – সেসব যে কেবল কোনও ক্রিস্টাল থেকেই পেতে হবে এমন কোনও কথা নেই। আমাদের সামনে এখন নতুন সম্ভাবনা নিয়ে এক বিপুল জগৎ এসে উপস্থিত হয়েছে, যে-জগতে এসবের স্বতন্ত্র নিয়মরীতি আছে। আমরা সে-জগতের পদার্থগুলোর নাম দিয়েছি কোয়াসিক্রিস্টাল।

এরকম নাম দেবার কারণ নতুন এই পদার্থটাকে আমরা সাধারণ ক্রিস্টালের থেকে আলাদা করে বোঝাতে চাই। উভয় পদার্থেই দেখা যাবে একই পরমাণুগুচ্ছ গোটা জিনিসটা জুড়ে পুনরাবৃত্ত হয়েছে।

ক্রিস্টালের পরমাণুগুচ্ছগুলো নির্দিষ্ট ব্যবধান অন্তর পুনরাবৃত্ত হয়। তার পাঁচরকমের প্যাটার্ন আমাদের জানা আছে। কোয়াসিক্রিস্টালের মধ্যে আলাদা আলাদা ধরনের গুচ্ছ তাদের যার-যার মতো নির্দিষ্ট স্বতন্ত্র ব্যবধানে পুনরাবৃত্ত হয়। আমাদের মনে ধরেছিল যেটা, সেটা হল দুই মাত্রার একটা প্যাটার্ন, যাকে বলা হয় পেনরোজ টাইলিং। পেনরোজ টাইলিং-এর প্যাটার্নটা অগতানুগতিক, সেখানে দুটো আলাদা ধরনের টাইলস থাকে, সেগুলোর এক-একটা যে-ব্যবধানে পুনরাবৃত্ত হয় তা অপরটার সঙ্গে কখনও ধাপে ধাপে মেলে না। গণিতবিদরা এ ধরনের প্যাটার্নকে বলেন কোয়াসিপিরিয়ডিক। সেখান থেকেই আমরা আমাদের আবিষ্কৃত এই তাত্ত্বিক জিনিসটার নাম দিয়েছিলাম কোয়াসিপিরিয়ডিক ক্রিস্টাল, বা সংক্ষেপে, কোয়াসিক্রিস্টাল।

আমার তত্ত্বের স্বপক্ষে সাজানো আমার ছোট্ট ডেমনস্ট্রেশনটা লেসার ফেলে দেখাচ্ছিলাম, আর ছিল কোয়াসিপিরিয়ডিক প্যাটার্নের ছবি দিয়ে তৈরি একটা স্লাইড। আমি ফাইনম্যানের কথামতো লেসারের সুইচটা টিপে দিলাম, আলোর বিমটাকে স্লাইডের ওপর এমনভাবে তাক করলাম যাতে সেটা তার ভেতর দিয়ে দূরের দেওয়ালে গিয়ে পড়ে। পরমাণুর অন্তর্বর্তী চ্যানেল দিয়ে এক্স-রে পাঠালে যা ঘটে, লেসার থেকেও ঠিক একইধরনের ঘটনা ঘটতে দেখা গেল, সৃষ্টি হল একটা ডিফ্র্যাকশন প্যাটার্ন।

আমি মাথার ওপরকার আলোটা নিভিয়ে দিয়েছিলাম যাতে ফাইনম্যান দেওয়ালের ওপর তৈরি হওয়া সূচিবন্দু আলো দিয়ে তৈরি অনেকটা তুষারকণার মতো দেখতে নকশাটাকে ভাল করে বুঝতে পারেন। ফাইনম্যান এর আগে যত ডিফ্র্যাকশন প্যাটার্ন দেখেছেন তার সঙ্গে এর কোনও মিল ছিল না।

আমি তাঁকে দেখালাম, যেমনটা বক্তৃতার সময়েও দেখিয়েছিলাম যে, সবথেকে উজ্জ্বল বিন্দুগুলো দশটা দশটা করে বিন্দুর এক-একটা বৃত্ত তৈরি করেছে, যেগুলো সমকেন্দ্রিক। এমনটা কেউ আগে শোনেনি। সূচিবিন্দু আলোর আরও কয়েকটা গুচ্ছ দেখা যাচ্ছিল সেগুলো এক-একটা পঞ্চভুজ তৈরি করেছে – বলতেই হবে যে তার মধ্য দিয়ে এমন একটা সিমেট্রির অস্তিত্ব প্রকাশ পাচ্ছে প্রকৃতির নিয়মে যার কোনও জায়গা নেই বলেই মনে করা হত। খুঁটিয়ে দেখলে ধরা পড়বে এই সূচিবিন্দুগুলোর মধ্যে আছে আরও অনেক বিন্দু এবং সেগুলোর মধ্যেও আছে আরও বিন্দু, তার মধ্যে আরও... আরও...

ফাইনম্যান স্লাইডটাকে ভাল করে দেখতে চাইলেন। আমি আলো নিভিয়ে স্লাইডের খাপ থেকে সেটাকে বার করে তাঁর হাতে দিলাম। স্লাইডের ভেতর ছবিটা এতই ছোট হয়ে আছে যে তার অনুপুঙ্খ বোঝা খুব মুশকিল ছিল, আমি তাই ওই টাইলিং প্যাটার্নের একটা বড় প্রিন্টও দিলাম, সেটাকে তিনি টেবিলের ওপর লেসারের সামনে নামিয়ে রাখলেন।

এর পরের কয়েক মুহূর্ত কাটল নিঃস্তব্ধতায়। আমার নিজেকে আবার ছাত্র বলে মনে হচ্ছিল, আমি যে উদ্ভট ভাবনা এনে হাজির করেছি ফের তার উত্তরে ফাইনম্যান কী বলেন সেটা জানার জন্য যেন অপেক্ষায় রয়েছি। তিনি টেবিলে রাখা বড় প্রিন্টটার দিকে চাইলেন, স্লাইডটাকে আবার তার খাপে ঢোকালেন, লেসারটা নিজেই অন করলেন। তাঁর চোখ ঘোরাঘুরি করতে থাকল টেবিলের বড়-করা প্রিন্টটায়, সেখান থেকে দেওয়ালে লেসার আলোয় তৈরি প্যাটার্নের দিকে, ফের টেবিলের প্রিন্টের দিকে।

‘ইমপসিবল!’ অবশেষে মুখ খুললেন ফাইনম্যান। আমি সায় দিয়ে মাথা নাড়লাম, মুখে হাসি ফুটল আমার, কারণ আমি জানি এই কথাটাই তাঁর সেরা প্রশংসাগুলোর অন্যতম।

তিনি দেওয়ালের দিকে ফিরে তাকালেন, মাথাটা ঝাঁকালেন। ‘অ্যাবসলিউটলি ইমপসিবল! দ্যাট ইজ ওয়ান অফ দ্য মোস্ট অ্যামেজিং থিংস আই হ্যাভ এভার সিন।’

আর তারপর একটাও কথা না বলে প্রফুল্ল মুখে আমার দিকে চেয়ে তাঁর রহস্যময় হাসিটা হাসলেন।

পল জে স্টাইনহার্ড প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে আলবার্ট আইনস্টাইন প্রফেসর ইন সায়েন্স। তিনি সেখানে ফিজিক্স এবং অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল সায়েন্স দুই বিষয়েরই অধ্যাপক পদে আছেন। আদি ব্রহ্মাণ্ড ও অভিনব ধর্মবিশিষ্ট পদার্থ সংক্রান্ত গবেষণার জন্য তিনি ডিরাক মেডাল এবং অন্য নানা সম্মান লাভ করেছেন।

রচনাটি স্টাইনহার্ডের লেখা The Second Kind of Impossible: The Extraordinary Quest for a New Form of Matter (Simon & Schuster, Inc., 2019) বইয়ের অংশবিশেষ। এই অংশটা নটিলাস পত্রিকার ৩১ জানুয়ারি ২০১৯-এ অনলাইন প্রকাশিত হয়েছিল।

যুধাজিৎ দাশগুপ্ত

অনুবাদ:

যুধাজিৎ দাশগুপ্ত